প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ হজ পালনের লক্ষ্যে মক্কা নগরীতে উপস্থিত হয়। সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা চরম আবেগ ও ব্যাকুলতা নিয়ে কাবার চারপাশে জমায়েত হয়। উদ্দেশ্য একটাই- করুণাময় মহান প্রতিপালকের দান ও ইহসানে ধন্য হওয়া, পুরস্কার ও প্রতিদানে কৃতার্থ হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকে খালি হাতে যায়, আবার খালি হাতেই ফিরে আসে। প্রাপ্তির ঝুলিতে কিছুই পড়ে না। এর কারণ কী? বহু কারণের অন্যতম কারণ হচ্ছে-অবশ্যপূরণীয় অনিবার্য শর্ত তথা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই হজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়া। তাই আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে এবার হজের জন্য কবুল করেছেন, তাদের উচিত সফরে রওনা হওয়ার আগেই হজের প্রতি ঐকান্তিক হওয়া এবং সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা।
বৈধ পথে উপার্জিত অর্থ
হজ যেমন একটি শারীরিক ইবাদত, তেমনি একটি অর্থনৈতিক ইবাদতও। কষ্ট, ক্লেশ ও শ্রম ব্যয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর টাকা-পয়সারও প্রয়োজন হয়। তাই হজের সফরে রওনা হওয়ার আগে অর্থনৈতিক প্রস্তুতি পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে এবং হজ পালনের যাবতীয় ব্যয় হালাল ও বৈধ উৎস থেকে বহন করতে হবে। কেননা ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-প্রার্থনা কবুলের জন্য হালাল, পবিত্র ও অনুমোদিত রিজিক হওয়া অন্যতম শর্ত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘হে লোকসকল! নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র। তিনি কেবল পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। রাসুলদেরকে তিনি যে আদেশ দিয়েছেন মুমিনদেরকেও সেই আদেশ দিয়েছেন।’ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে রাসুলগণ! আপনারা উত্তম ও পবিত্র রিজিক আহার করুন এবং সৎকর্ম করুন। আপনারা যেসব আমল করেন আমি সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত’ (সুরা মুমিনুন : ৫১)। আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা হালাল ও উত্তম রিজিক আহার করো, যা আমি তোমাদের দিয়েছি’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। অতঃপর রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে-হে আমার প্রভু! হে আমার প্রভু! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কীভাবে কবুল হবে? (মুসলিম : ১০১৫)
পার্থিব ঝামেলা থেকে মুক্তি
হজের গুরুত্বপূর্ণ বিধান মূলত প্রেমিক বান্দার রহস্যময় প্রেমকীর্তি। শুভ্র-সুন্দর পোশাক পরে তালবিয়া পাঠ, কাবার চারপাশে তওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মাঝে সায়ি, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান, জমারায় রমি, মিনায় কুরবানি-মহান স্রষ্টার প্রতি নগণ্য সৃষ্টির প্রেম নিবেদনমূলক এসব কীর্তি একজন মানুষ নিবিষ্ট চিত্তে তখনই আদায় করতে পারে, যখন দুনিয়ার সব ঝামেলা ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। তাই দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ একাগ্র চিত্ত নিয়ে হজব্রত পালন করতে যেতে হবে। দুনিয়াবি ব্যস্ততা ও কাজকর্ম থেকে ফারেগ হয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার উৎসাহ এসেছে হাদিসে কুদসিতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেব। যদি তা না করো তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেব আবার অভাবও দূর করব না।’ (তিরমিজি : ২৪৬৬)
ভালো সঙ্গী নির্বাচন
কথায় আছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ এটা শুধু ছোটদের জন্য নয়, বড়দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং হজের মতো আমলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হজে যেমন অতি সহজে আল্লাহর সান্নিধ্য, প্রাপ্তি ও পুরস্কার লাভ করা যায়, তেমনি অসৎ সঙ্গী-সাথিদের পাল্লায় পড়ার কারণে ক্ষতিরও কারণ হয়। অনেককে দেখা যায়, হজ করে এসে আগের চেয়ে খারাপ জীবনযাপন করে, মন্দ ও অসৎ পথে চলে, ধোঁকা ও প্রতারণার বাজার সরগরম রাখে। যেন হজের মাধ্যমে এসবেরই লাইসেন্স নিয়ে এসেছে সে। এটা তার হজ কবুল না হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই হজে বের হওয়ার আগে মুত্তাকি, পরহেজগার ও ভালো মানুষ নির্বাচন করতে হবে এবং তাদের পুণ্যসান্নিধ্যে হজপালনের চেষ্টা করতে হবে। একজন মুত্তাকি সাথি খুঁজে পাওয়া তেমন কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। সদিচ্ছা থাকলে খুব সহজেই ভালো সাথি মিলে যেতে পারে। আর পাঁচ-সাতজন ভালো মানুষের সঙ্গে হজ করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। রাসুলুল্লাহ (সা.) ভালো-মন্দ সঙ্গীর উপকার ও অপকার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হলো, আতর বিক্রেতা ও কামারের হাপরের মতো। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার কাছ থেকে তুমি কিছু কিনবে অথবা তার কাছ থেকে তুমি সুবাস পাবে। আর কামারের হাপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে কিংবা তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি : ৫৫৩৪)
হজের বিধিবিধান জানা
যেকোনো কাজ সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পালনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, কাজটি সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করা এবং ইতপূর্বে যারা কাজটি করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। ইসলামের অন্যতম রোকন হজের বিধান সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে আদায় করতে হলেও এ সম্পর্কেও পূর্ণ অবগতি লাভ করতে হবে। ইহরাম, তালবিয়া, তওয়াফ, সায়ি, উকুফে মুযদালিফা, উকুফে আরাফা, রমি, কুরবানি প্রভৃতি বিধি-বিধান সম্পর্কে জানতে হবে। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দোয়া, বিশেষ করে তালবিয়া তথা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননিমাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক’ শিখতে হবে। তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে হজ পালনের অপূর্ব সৌভাগ্য দ্বারা ধন্য করেছেন এমন প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হজ ক্যাম্প বা এজেন্সিগুলোও হজের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। হজে যাওয়ার আগে এসব ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিলে হজের আমলগুলো আদায়ের নিয়ম খুব সহজে রপ্ত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) হজ পালন করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে এই বলে হজের বিধান শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন যে, ‘তোমরা আমার থেকে হজের বিধিবিধান শিখে নাও’ (নাসায়ি : ৩০৬২)। সাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেইনসহ পরবর্তী সবাই নবী (সা.)-এর শিক্ষা ও উপদেশ মেনে হজের বিধান পালন করেছেন। আল্লাহ পাকের যেকোনো বিধান পালনের আগে সে বিধান সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা ফরজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজা : ২২৪)
পরিবারের খরচাদি ও ঋণের দায়মুক্তি
হজ ফরজ হওয়ার অত্যতম শর্ত হচ্ছে সফরকালীন পরিবারের খাদ্য-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে যাওয়ার সামর্থ্য থাকা। তাই সফরের এক দেড় মাস সময়ে পরিবারের সদস্যরা কোথা থেকে প্রয়োজন মেটাবে তার ব্যবস্থা, দিকনির্দেশনা ও অর্থের জোগান দিয়ে যেতে হবে। যাতে গৃহকর্তার অবর্তমানে পরিবারস্থ কেউ সংকট-সমস্যার সম্মুখীন না হয়। কেউ যদি কোনো টাকা পায় তা হলে যথাসম্ভব আদায় করে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব না হলে সময় চেয়ে নিতে হবে এবং এ ধরনের ঋণের কথা পরিবারের লোকজনের কাছে বলে যেতে হবে। কেননা জীবন-মৃত্যুর সময়সন্ধিক্ষণ অনিশ্চিত। যেকোনো সময় যে কারও মৃত্যুর যবনিকাপাত ঘটতে পারে। একইভাবে যদি বোনের অংশ না দেওয়া হয়ে থাকে অথবা শয়তানের প্ররোচনায় যদি কারও হক নষ্ট করা হয়ে থাকে তা হলে হজের পূর্বে অবশ্যই তার সমাধান করে যেতে হবে। মানুষের হক মেরে, অধিকার খর্ব করে হজের প্রকৃত প্রাপ্তি ও সুফল লাভ করা সম্ভাব হবে না।
নিয়তের বিশুদ্ধতা
সবচেয়ে বড় কথা হলো হজে যাওয়ার সময় অন্তরে রিয়া, লৌকিকতা ও মানুষের স্তুতি-বন্দনার লোভ না রেখে শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ ও সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা রাখতে হবে। কেননা যেকোনো আমল আল্লাহ তায়ালার দরবারে গ্রহণযোগ্য ও পুরস্কারের উপযুক্ত হওয়ার জন্য জরুরি হলো ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল; মানুষ যা নিয়ত করবে তা-ই পাবে। সুতরাং, যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উদ্দেশ্যে হবে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উদ্দেশে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে তার হিজরত ওই উদ্দেশ্যেই বিবেচিত হবে’ (বুখারি : ১)। সুতরাং হজপালনে যদি লোক দেখানো উদ্দেশ্য হয় এবং ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত অনুপস্থিত থাকে তা হলে পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা, আল্লাহ তায়ালার কাছে তা গ্রহণীয় বলেই বিবেচিত হবে না।
আলেম ও প্রাবন্ধিক
সময়ের আলো/আরএস/