ই-পেপার শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

রবার্ট মুগাবে : জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতার নায়ক থেকে স্বৈরশাসক
প্রকাশ: সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম  (ভিজিট : ১৯৮)
বাধীন জিম্বাবুয়ের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে দেশটির প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের অবসানের আশ^াস দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে যে স্বপ্ন অর্জিত হয়েছিল, তা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্নীতি ও সহিংসতার প্রকোপে। পশ্চিমা নীতির, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের কড়া সমালোচক ছিলেন প্রেসিডেন্ট মুগাবে। যুক্তরাজ্যকে ‘শত্রæ দেশ’ হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের ওপর নির্মম অত্যাচার করা বা অব্যবস্থাপনার কারণে একসময়কার সমৃদ্ধিশালী দেশকে দুর্দশার মুখে ঠেলে দিলেও তার জন্য আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নেতাদের সমর্থনের কমতি ছিল না কখনও।
১৯২৪ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি তৎকালীন রোডেশিয়ায় জন্ম নেন রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবে। বাবা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘শোনা’ ভাষাভাষী গোষ্ঠীর সদস্য এবং পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। মুগাবে রোমান ক্যাথলিক মিশন স্কুলে পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পান। ঘানায় শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরুর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ফোর্ট হেয়ার বিশ^বিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পান মুগাবে, তার সাতটি একাডেমিক ডিগ্রির প্রথমটি এই ফোর্ট হেয়ার বিশ^বিদ্যালয় থেকে নেওয়া। ঘানায় কাজ করার সময় সেখানকার স্বাধীনতাপরবর্তী নেতা কোয়ামে এনক্রুমাহ’র আফ্রিকান একত্ববাদের আদর্শ তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।
মুগাবের প্রথম স্ত্রী স্যালি ছিলেন ঘানার নাগরিক। ১৯৬০ সালে রোডেশিয়ায় ফিরে যান মুগাবে। জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের (জানু) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার আগে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জশুয়া এনকোমোর সঙ্গে কাজ করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে এক ভাষণে রোডেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার সমর্থকদের ‘কাউবয়’ বা মেষপালক বলার পর মুগাবেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর প্রায় এক দশক কোনো বিচার ছাড়াই তাকে আটকে রাখা হয়। তিনি কারাগারে থাকাকালীন সময়ই তার শিশু সন্তান মারা যায়। তাকে ছেলের শেষকৃত্যে উপস্থিত হওয়ারও অনুমতি দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৩ সালে আটক থাকা অবস্থাতেই জানুর প্রেসিডেন্ট হন তিনি।
কারামুক্তির পর তিনি মোজাম্বিকে যান এবং রোডেশিয়ায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেন। তার সংস্থা জানু সে সময় জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপলস ইউনিয়নের (জাপু) সঙ্গে দুর্বল একটি জোট গঠন করে। রোডেশিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে হওয়া রক্তক্ষয়ী আলোচনা চলাকালীন সময় আফ্রিকান নেতাদের মধ্যে মুগাবেই ছিলেন সবচেয়ে আগ্রাসী এবং দাবি আদায়ে সে সময় তার ভ‚মিকাই ছিল সর্বাপেক্ষা আপসহীন। ১৯৭৬ সালে লন্ডন সফরের সময় তিনি মন্তব্য করেন যে, রোডেশিয়া সমস্যার একমাত্র সমাধান আসতে পারে বন্দুকের নল থেকে।
আগ্রাসী মনোভাবের জন্য খ্যাতি থাকলেও আলোচনার ক্ষেত্রে মুগাবের দক্ষতার কারণে সাবেক সমালোচকরা পরে যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন তার।
সংবাদমাধ্যম তাকে ‘চিন্তাশীলের গেরিলা’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেছিল। ১৯৭৯ সালে ল্যানসাস্টার হাউস চুক্তি অনুযায়ী ‘জিম্বাবুয়ে প্রজাতন্ত্রী’র জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যে সংবিধান মোতাবেক রোডেশিয়ার নতুন নাম ঠিক করা হয় জিম্বাবুয়ে। জিম্বাবুয়ের প্রথম সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৮০ সালের ফেব্রæয়ারিতে। জাপুর নেতা এনকোমো’র দলে না থেকে অন্য দল থেকে নির্বাচন করা মুগাবে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করেন।
নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের অনেকে ওই বিজয়কে অপ্রত্যাশিত হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে জানু সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যদিও নির্বাচনে দুই পক্ষই ভোট জালিয়াতি ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ তুলেছিল। সেবারের নির্বাচনে ‘স্বঘোষিত মার্ক্সবাদী’ মুগাবে যখন জয়লাভ করেন তখন অনেক শে^তাঙ্গই রোডেশিয়া ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। তবে মুগাবের মধ্যমপন্থি এবং শান্তিপূর্ণ বক্তব্য তার অনেক সমর্থককেই সে সময় আশ^স্ত করেছিল।
সে সময় তিনি প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন যে, বিরোধীদের ভুক্তভোগী করা হবে না এবং ব্যক্তিগত সম্পদকে রাষ্ট্রের দখলে নেওয়া হবে না। তিনি দাবি করেছিলেন তার রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্যই হবে বন্ধুবৎসলতার প্রসার। সে বছরের শেষে তিনি তার অর্থনৈতিক নীতি চ‚ড়ান্ত করেন যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি বিনিয়োগের জন্য বিবেচনা করার নীতি রাখেন। প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগত একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় সমর্থন প্রকাশ করায় মুগাবে আর এনকোমোর মধ্যে দ্ব›দ্ব বাড়তে থাকে। এরপর জাপু মালিকানাধীন এলাকায় প্রচুর অস্ত্রের গুপ্ত ভান্ডার পাওয়ার পর এনকোমোকে সরকার থেকে বহিষ্কার করা হয়। মুগাবে ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করেছিলেন। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে হাজার হাজার এনডেবেলেস গোষ্ঠীর মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, যারা এনকোমোর আদি বাসস্থান মাতাবেলেল্যান্ডের অধিবাসী ছিল এবং যাদের এনকোমোর সমর্থক হিসেবে মনে করা হতো।
জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনীর ফিফথ গ্রিগেডের যারা উত্তর কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলÑ পরিচালনা করা হত্যার সঙ্গে মুগাবে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠলেও তাকে কখনও বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস বিলুপ্ত ঘোষণা করার পর ১৯৮৭ সালে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট হন মুগাবে। ১৯৯৬ সালে তৃতীয় দফায় নির্বাচিত হন তিনি। সে বছরই গ্রেস মারুফুকে বিয়ে করেন তিনি। মুগাবের চেয়ে ৪০ বছরের ছোট মারুফুর সঙ্গে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের সে সময় দুজন সন্তান ছিল। তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয় মুগাবের বয়স যখন ৭৩। বৈষম্যমুক্ত সমাজ তৈরিতে তার কিছু সাফল্য থাকলেও ১৯৯২ সালে ভ‚মি অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করে কোনো আবেদন ছাড়াই ভ‚মি অধিগ্রহণের নিয়ম তৈরি করেন। জিম্বাবুয়ের উৎকৃষ্ট মানের ভ‚মির দখল রাখা সাড়ে ৪ হাজার শে^তাঙ্গ কৃষকের হাত থেকে জমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করাই ছিল তার এই নীতির প্রধান লক্ষ্য। একবিংশ শতকের প্রথম দশকে তার সরকারের বিরোধী দলের সমর্থনে থাকা শে^তাঙ্গ কৃষকদের খামার দখল এবং তাদের অধীনে
থাকা কৃষ্ণাঙ্গ কৃষকদের হত্যা করে মুগাবের তথাকথিত ‘যুদ্ধফেরত’ বাহিনী।
জিম্বাবুয়ের কৃষি খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে যাওয়ার কারণে মুগাবের সমালোচকরা তাকে দোষারোপ করেন। সমালোচকদের দাবি ছিল, জমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করার পর গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তা হস্তান্তর করার বদলে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের সেসবের দায়িত্ব দেন তিনি।
আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি খাদ্য উৎপাদন করা দেশগুলোর একটি থেকে দ্রæত বিদেশি বিনিয়োগনির্ভর দেশে পরিণত হয় জিম্বাবুয়ে।
২০০২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুগাবে প্রায় ৫৭ শতাংশ ভোট পান এবং তার বিরোধী দল এমডিসি পায় প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট। ওই নির্বাচনে মুগাবের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো এবং অনেক গ্রামে ভোটারদের ভোট দেওয়া থেকে রুখতে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
সহিংসতা এবং জালিয়াতির অভিযোগ থাকায় সে সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি। তারপর থেকেই মুগাবে এবং জিম্বাবুয়ে বাকি বিশ^ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করে। দেশের গণতন্ত্র পরিস্থিতি উন্নয়নের আগ পর্যন্ত কমনওয়েলথের বৈঠক থেকেও জিম্বাবুয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০৫ সালে জিম্বাবুয়েতে কালোবাজারি বন্ধ করার লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত দেন মুগাবে, যার ফলশ্রæতিতে রাস্তায় ব্যবসা করা ৩০ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গ্রেফতার হন এবং আনুমানিক সাত লাখ জিম্বাবুইয়ান গৃহহীন হয়ে পড়েন।
২০০৮-এর মার্চে প্রথম দফা নির্বাচনে হারলেও জুনে দ্বিতীয় দফায় তার প্রতিদ্ব›দ্বী মি. সভাঙ্গিরাই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে আবারও নির্বাচিত হন তিনি। মি. সভাঙ্গিরাইয়ের সমর্থকদের ওপর হামলা নির্যাতন অব্যাহত থাকায় কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে দাবি করে আসছিলেন তিনি। ফেব্রæয়ারি ২০০৯-এ মি. সভাঙ্গিরাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করান মুগাবে। তবে মি. সভাঙ্গিরাইয়ের সমর্থকরা তখনও নির্যাতন এবং হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন। ২০১৩ সালে আবারও ৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুগাবে, যার ফলে আবারও এককভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তিনি।
সেবারের নির্বাচনেও কারচুপির অভিযোগ ওঠে তবে সে সময় আগের নির্বাচনগুলোর মতো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। এরপর ধীরে ধীরে মুগাবের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ধারণা করা হতে থাকে যে, তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন তার স্ত্রী গ্রেস মুগাবে। ২০১৫ সালে রবার্ট মুগাবে ঘোষণা করেন যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবেন, যখন তার বয়স হওয়ার কথা ৯৪। ফেব্রæয়ারি ২০১৬-তে তার উত্তরসূরি কে হবেন? এমন আলোচনা চলাকালীন সময় এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ^র তুলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকব।’
তবে ঈশ^র নয়, জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মুগাবে। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর গৃহবন্দি হন মুগাবে এবং তার চার দিন পর তার রাজনৈতিক দল জানু-পিএফ পার্টির শীর্ষ নেতার পদ থেকে প্রতিস্থাপিত হন। পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার আগে তিনি এবং তার পরিবার ভবিষ্যতে যাতে বিচারের সম্মুখীন না হনÑ সে জন্য একটি চুক্তিও করেন। এর ফলে তার কিছু ব্যবসায়িক স্বার্থও রক্ষা হয়েছিল।
তিনি ক‚টনৈতিক মর্যাদাসহ গাড়ি-বাড়িরও সুবিধা
ভোগ করতেছিলেন।
পরবর্তীতে অনাড়ম্বরপূর্ণ ও রক্ষণশীল পোশাকেই তাকে দেখা যেত। এমনকি মদ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। বন্ধু হোক আর শত্রæ হোকÑ সবাইকেই সন্দেহ করা শুরু করেছিলেন যে, তারা যেকোনো সময় তার কোনো ক্ষতি করতে পারে। আফ্রিকা থেকে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দূর করতে মুগাবে বড় ভ‚মিকা পালন করেছিলেন বলে মনে করা হতো, যার জন্য তিনি পুরো আফ্রিকায় নায়কের সম্মান পেতেনÑ সেই মুগাবেই পরিণত হয়েছিলেন স্বৈরশাসকে। ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে একসময়কার সমৃদ্ধিশালী জিম্বাবুয়েকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিলেন তিনি। জিম্বাবুয়েকে বহু বছর তাড়া করে বেড়াবে মুগাবের রাজনীতির লিগ্যাসি। (বিবিসি অবলম্বনে)




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close