ই-পেপার মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকিয়ে দীর্ঘদিন আয়েশে থাকার পাঁয়তারা
এনজিও কর্মীদের বিলাসী জীবন
প্রকাশ: শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম আপডেট: ২০.০৯.২০১৯ ১২:১৫ এএম  (ভিজিট : ৭৫৭)
১২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের কলাতলী বাস টার্মিনাল সড়কে তখন ব্যাপক যানজট। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় একই স্থানে আটকে থাকতে হয়।

অনেকটা রাজধানী ঢাকা শহরের ব্যস্ত সড়কে আটকে থাকার মতো। এখানে দেখা গেল অধিকাংশ যানবাহনই জিপ, কার, মাইক্রোবাস কিংবা পাজেরোসহ বিলাসবহুল আরও কিছু গাড়ি। প্রায় প্রতিটি গাড়িতেই দেখা যায় বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিও সংস্থার লোগো। অধিকাংশ গাড়ির ভেতরে সুন্দরী তরুণীর সংখ্যাই বেশি।

স্থানীয়রা এ সময় জানালেন যানজটে আটকে থাকা এসব যানবাহনের ভেতরে রয়েছেন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিওর কর্মীরা। তারা থাকেন কক্সবাজারের ফাইভ স্টার বা ফোর স্টার মানের হোটেলে। তাদের চলাফেরা, খাবার ও পোশাক-বেশভূষা যেন উন্নত দেশের ফরেনারদেরও হার মানায়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করার এই অজুহাতে বর্তমানে তারা ব্যাপক বিলাসী জীবন উপভোগ করছেন। আর এ কারণেই এসব এনজিও কর্মী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে দীর্ঘদিন কক্সবাজারে থেকে যাওয়ার পাঁয়তারা করছেন বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা এক শ্রেণির এনজিও কর্মীর এই বিলাসী জীবনের নেপথ্যেও রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার লোগো থাকায় এনজিও কর্মীদের অধিকাংশ বিলাসী গাড়ি তল্লাশি করা হয় না।
অথচ অভিযোগ রয়েছে, এসব গাড়িতে করেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখন টেকনাফ ও উখিয়া থেকে ইয়াবার চালান ও নারী পাচারের ঘটনা ঘটছে। এসব গাড়ির গ্লাসও কালো। ইয়াবার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সুন্দরী তরুণী বা নারীদের এসব কালো গ্লাসের গাড়িতে করেই কক্সবাজারে এনে আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়।

কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, এক শ্রেণির এনজিও কর্মীর ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের উসকানি, প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকান্ড ও নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এর আগেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় বেশ কিছু এনজিওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক এনজিওর গাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনাও রয়েছে। এসব বিষয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির পর ১৩৯টি এনজিও ওই এলাকায় তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। এর মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকায় তালিকা করে ৪১টি এনজিওকে সব ধরনের কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখনও উখিয়া ও টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজারে লক্ষাধিক এনজিও কর্মী কর্মরত রয়েছেন। এসব এনজিওর অধিকাংশই জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনএইচসিআর’র ছত্রছায়ায় কাজ করছে বলে জানা যায়।

কক্সবাজারের সাধারণ মানুষ ও একাধিক এনজিও কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গা সংকট বাড়লেও কপাল খুলেছে এক শ্রেণির এনজিও কর্মীর। যারা আগে এক সময় বাইসাইকেল নিয়ে চলাচল করতেন তারা এখন ব্যবহার করেন জিপ বা কার। যারা কিছুদিন আগেও ভাড়ায় থাকতেন টিনশেড বা কোনোরকম পাকা দালান বাড়িতে তারা এখন থাকছেন ফোর স্টার-ফাইভ স্টার হোটেলে। বেতন-টিএডিএ বেড়েছে তাদের কয়েকগুণ। তাও আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাচ্ছেন ডলারে। অধিকাংশ এনজিওতে রয়েছে সুন্দরী তরুণীদের ব্যাপক চাহিদা। অনেকেই কলেজ বা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই পাঠ না চুকিয়ে অর্থ আর বিলাসী জীবনের লোভে ঢুকে গেছেন এনজিওতে। অনেক সময় এনজিওর বড় কর্তাদের মনোরঞ্জনও করতে হচ্ছে এক শ্রেণির সুন্দরী তরুণী এনজিও কর্মীকে। তারাও অর্থের লোভে সহজভাবেই নিচ্ছেন ব্যাপারগুলো। বসদের মন জয় করতে পারলেই মাসে মাসে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। এনজিও কর্মীদের এই বিলাসিতা এবং আপত্তিকর চলাফেরার এসব কথা এখন কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

স্থানীয়রা আরও জানান, অধিকাংশ দিনই সকাল ৭টার দিকে এনজিও কর্মীরা বের হন উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। একইভাবে বিকাল ৩টার দিকে আবার সেখান থেকে রওনা দেন কক্সবাজার শহরের উদ্দেশ্যে। এই দুই সময়েই কক্সবাজারের বেশ কিছু সড়কে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ওইসব এলাকায় এনজিও কর্মীদের গাড়ির চাপে সাধারণ মানুষের চলাচল করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
উখিয়ার স্থানীয় অটোরিকশা চালক মো. আলী সময়ের আলোকে বলেন, আমার এমন পরিচিত বেশ কয়েকজন এনজিও কর্মী আছে যারা আগে অনেক অস্বচ্ছল জীবন যাপন করতেন। এই দুই-আড়াই বছরে রোহিঙ্গা সংকট বাড়ার পর তারা এনজিওতে ঢুকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো অবস্থা।
তিনি আরও জানান, স্থানীয় অনেক সুন্দরী তরুণীর এসব এনজিওতে যোগ দেওয়ার পর পরই তাদের চলন-বলন রাতারাতি পাল্টে গেছে। কাজের অবসরে কিংবা ছুটির দিনগুলোতে বসদের সঙ্গে প্রকাশ্যেই তারা রিসোর্টসহ বিভিন্ন স্থানে সময় কাটান।
কক্সবাজারের কলাতলীর স্থানীয় বাসিন্দা ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ডিএম রুস্তম সময়ের আলোকে বলেন, বেশিরভাগ এনজিও কর্মী কক্সবাজারের বিলাসবহুল হোটেল কক্স টুডে, ওশান প্যারাডাইস, লংবিস, রয়্যাল টিউলিপসহ নামিদামি আবাসিক হোটেলে থাকেন। আবার অনেকে বেশ উচ্চ ভাড়ায় বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ভাড়া করেও থাকছেন। সমস্যা যেটি দাঁড়িয়েছে তা হলো এই এনজিও কর্মীদের কারণে কক্সবাজারের সাধারণ মানুষদের জীবন যাপন পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কক্সবাজারে দুই-আড়াই বছর আগে যে বাসাটি পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত সেটির ভাড়া এনজিও কর্মীদের কারণে বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। যে মাছ দুই-আড়াইশ টাকা কেজিতে পাওয়া যেত এখন সেটি ৫০০-৬০০ টাকা কেজি। তেমনি বাজারের সবজি থেকে শুরু করে যানবাহনের ভাড়া ও নিত্যপণ্যের কয়েকগুণ দাম বেড়েছে। যেহেতু রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করার ফলে এনজিও থেকে মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, ফলে বাজারের যেকোনো কিছু বলতে গেলে বিক্রেতারা যা চান তা দিয়েই কিনে নিচ্ছেন এনজিও কর্মীরা। দামাদামির প্রয়োজনও মনে করেন না তারা। এনজিও কর্মীদের এই বিলাসী জীবনের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় সাধারণ মানুষের জীবনে।
স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে নিরাপদে ইয়াবা পাচার করছে দেশি-বিদেশি কতিপয় এনজিও সংস্থা। এসব এনজিও কর্মীদের বহনে ব্যবহৃত গাড়ি থেকে ইতোমধ্যে কয়েক দফায় ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় নামে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর স্টিকারযুক্ত গাড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশির আওতামুক্ত থাকায় এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ইয়াবা সিন্ডিকেট। আবার কোনো কোনো ইয়াবা গডফাদার পাচারের জন্য নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে এনজিও কর্মীদের। গডফাদারদের নির্দেশেই অনেকে ইয়াবা কারবারের জন্য ঢুকে পড়ছে এনজিওতে। এরপর স্টিকারযুক্ত অধিকাংশ গাড়িতে চলছে রমরমা ইয়াবা পাচার। তারা কৌশলে এনজিওর আইডি কার্ড সংগ্রহ করে তা গলায় ঝুলিয়ে সারা ক্যাম্প বিচরণ করলেও তাদের দেখার কেউ নেই, সন্দেহ করার কেউ নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইয়াবা পাচার করছে একাধিক চক্র। ইয়াবা ও নারী পাচার কাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে নামি-দামি কালো গ্লাসের সব গাড়ি।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবির থেকে ইয়াবা পাচারের সময় কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে ধাওয়া করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) স্টিকারযুক্ত গাড়ি থেকে ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধারসহ ওই গাড়ির চালককে আটক করা হয়। ৬ এপ্রিল সকালে দমদমিয়া চেকপোস্টে ১০ হাজার ২৯ পিস ইয়াবাসহ লাকি শর্মা নামে এক এনজিও কর্মীকে আটক করে বিজিবি। দীর্ঘদিন ধরে এই নারী টেকনাফে গণস্বাস্থ্য নামে একটি এনজিও সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। তার আগে গত বছরের ৬ নভেম্বর টেকনাফ ডিগ্রি কলেজ এলাকায় ‘ডিসিএ’ নামে একটি এনজিও সংস্থার স্টিকার লাগানো মাইক্রোবাস থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার ইয়াবাসহ চালক মীর কাশেমকে আটক করে র‌্যাব-৭। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার শহরের হলিডে মোড় থেকে ইয়াবাসহ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) নোহা গাড়ির চালক সেলিমকে আটক করেছিল পুলিশ।

‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’-এর কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, কক্সবাজারের সব অপরাধের মূলেই রয়েছে ইয়াবা কারবার। আর এই ইয়াবার প্রচলন এসেছে রোহিঙ্গাদের হাত ধরে। এখন এটি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা এক শ্রেণির এনজিও কর্মীর মাধ্যমেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। কেননা ক্যাম্পে কাজ করার সুবাদে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এসব এনজিও কর্মীদের ব্যাপক সখ্য গড়ে উঠছে। সেখান থেকেই তারা এ ইয়াবা চক্রে জড়িয়ে যাচ্ছে।

‘আমরা কক্সবাজারবাসী’র সমন্বয়ক করিম উল্লাহ কলিম সময়ের আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করার সুবাদে আন্তর্জাতিক সংস্থার লোগো ব্যবহার করে কক্সবাজারে এনজিও কর্মী অবাধ চলাফেরার সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। সেই সুযোগকে অনেকেই কাজে লাগিয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জোরালো ভ‚মিকা পালন করতে হবে।




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close