ই-পেপার শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ক্যাম্পে গিয়ে গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতাম
প্রকাশ: শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম আপডেট: ০৬.১২.২০১৯ ১২:৪০ এএম  (ভিজিট : ২০৪)
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের খুব উদ্বুদ্ধ করেছিল। এর আগে গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা রাস্তায় রাস্তায় জাগরণমূলক গান গাইতাম। শহীদ মিনার, রমনা বটমূল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটেও গাইতাম। পুলিশ ধাওয়া করত। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ফিলোসফিতে ভর্তি হলাম। তিন মাস ক্লাস করতে পেরেছিলাম। তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আমার বিয়ে হয়। বিয়ে না হলে ঢাকা ছাড়তে পারতাম না। একা একা কীভাবে যাব? কারফিউ, ব্ল্যাক আউট...কত কী তখন। তবু দেশের জন্য কিছু করার তাড়না ছিল। বিয়ের পর আগরতলায় যাই। সেখানে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকদের অনেকেই ছিলেন। আমরা সবাই রুমে পাটি বিছিয়ে থাকতাম। কোনো বালিশ নেই। একদিকে মেয়েরা, আরেকদিকে ছেলেরা থাকত। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ছিল কলাপাতায় খিচুড়ি, বেগুন ভাজা অথবা সবজি। এখন ভাবি, ইন্ডিয়া বর্ডার যদি খুলে না দিত, তাহলে এই যে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলাম, আমরা কেউই বোধ হয় বাঁচতাম না। আগরতলায় তিন দিন থাকার পর কলকাতায় চলে এলাম। আমার খালা শাশুড়ির বাড়ি ১০৪ পার্ক স্ট্রিটে। কলকাতায় দেখি পরিচিত অনেক লোক। ছায়ানটেরও। সবাইকে পেয়ে মনে হলো আমি একা নই। আমরা খোঁজ পেলাম, ১৪৪ লেনিন সরণিতে একটা সংগঠন হয়েছে ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতি’। এরপর হয়েছে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী স্মৃতি সংস্থা’। সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল উদ্যোক্তা। তিনি আমাদের জন্য একটা রুম ছেড়ে দিলেন। ওখানে আমি, বেণু, ডালিয়া নওশিনসহ অনেকেই রিহার্সাল করতাম। প্রথমে ছিলাম ১৭-১৮ জন। পরে রাজশাহী, রংপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও অনেকে এসেছে। দল দাঁড়াল ১১৭ জনে। এরা সবাই কিন্তু শিল্পী ছিল না। তবে সবার গলায় সুর ছিল। তাদের শিল্পী হিসেবে তৈরি করে নিতে হয়েছে। ওখানে আমরা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতাম। শরণার্থী ক্যাম্পের সে কী দৃশ্য! কারও চোখ নেই, কারও হাত নেই। কী যে আর্তনাদ তাদের! আমরা মনে সাহস রাখছিলাম। গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জোগাচ্ছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে কার্যক্রম ছিল আমাদের।
আমাদের কাজ ছিল ঘুরে ঘুরে গান গাওয়া। উদ্দেশ্য ছিল টাকা-পয়সা যা পাব, সেগুলো দিয়ে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোতে খাবার ও ওষুধপত্র সরবরাহ করা, শীতকালে কম্বল দেওয়া। সংগঠন থেকে ট্রাক আসত। ট্রাকে চেপে সবাই বেরিয়ে পড়ত গান গাইতে। মেয়েরা সাধারণত দূরে কোথাও যেত না। তবে আমি বহরমপুর, শান্তিনিকেতন, কল্যাণী, আসানসোল, এমনকি দিল্লিতেও গিয়েছি। দিল্লির পূজামণ্ডপে গান গেয়েছি। সেখানে গেলে অনেক টাকা পাওয়া যেত। ওখানকার অনেক শিল্পীই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অনেক সহযোগিতা করেছেন। এদের মধ্যে পঙ্কজ সাহা সবার প্রোগ্রাম ঠিক করে দিতেন। আমাদের সঙ্গী হতেন। সৌম্য মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, তারা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় তারাও সংগঠনটিতে যুক্ত ছিলেন। আমরা নানা গ্রুপে ভাগ হয়ে যেতাম। দেখা গেল এক গ্রুপ গেলাম বহরমপুর, আরেক গ্রুপ নিয়ে আরেক জায়গায় গেলেন ওয়াহিদ ভাই (ওয়াহিদুল হক)। আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তাফা মনোয়ার, তারেক আলী, এনামুল হক, ডালিয়া নওশিন, শারমিন মোরশেদ, লতা চৌধুরী তারাও আমাদের সংগঠনে ছিলেন। আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট ছিল ‘রূপান্তরের গান’। বিভিন্ন স্টেজে ১৫-১৬ জন মিলে পরিবেশন করতাম। নির্দেশনা দিতেন সৈয়দ হাসান ইমাম। ব্যাকগ্রাউন্ড ডিজাইন করতেন মুস্তাফা মনোয়ার। বিরাট লাল সূর্যের সেই ব্যাকগ্রাউন্ড কী যে সুন্দর ছিল! অনুষ্ঠানগুলোতে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। ‘আমাদের সংগ্রাম চলবে’সহ এ ধরনের গানগুলো গাইতাম। দর্শক-শ্রোতারা ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে উঠত ‘জয় বাংলা...’। এসব অনুষ্ঠানের কারণে তখন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ গান গাওয়ার মতো সময় ছিল না। ওখানে তো থাকারও জায়গা ছিল না। তা ছাড়া বালিগঞ্জে ‘স্বাধীন বাংলা’র স্টুডিওটাও তো ছোট। রথীন্দ্রনাথ রায়, আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, কাদেরী কিবরিয়া, সুজেয় শ্যাম...তাদের মতো বড় বড় শিল্পী ওখানে ছিলেন। তবু আমাদের ডাক পড়ল। এত ব্যস্ততার মধ্যেও মোরশেদ আলী, বিপুল ভট্টাচার্যসহ ৭-৮ জন মিলে ৮-৯টা গান গেয়ে এলাম। সেই গানগুলো সর্বক্ষণ বাজত। এরপর আবার সমরদা (সমর দাস) ডাকলেন। তখন আমরা নিজেদের জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত গাইলাম। এরপর আবার ফিরে গেলাম কলকাতায়। এক মাস পর আবার ডাক পড়ল। আমরা এবার যেতে না পারলেও টালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে ১৪টা গান রেকর্ড করে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে’ জমা দিলাম। সেগুলোও বাজতে থাকল। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামীতে’ও ছিল, আবার ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ও। তবে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে’ আমরা দুবারই গিয়েছিলাম। এখন অনেকেই এ নিয়ে অনেক কিছু বলে। কেউ কেউ আমাদের ইঙ্গিত করে বিভেদ টেনে বলে, ‘ওনারা তো স্বাধীন বাংলা বেতারে ছিলেন না।’ এসব কথা পাত্তা দিই না আমি, তবে দুঃখ লাগে ঠিকই!
বাংলাদেশের প্রথম জেলা হিসেবে যশোর শত্রুমুক্ত হলো ৬ ডিসেম্বর। তার আগেই নভেম্বরে সংগঠন থেকে বলা হলো, আমরা কেউ যদি সেখানে যেতে চাই, নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যেতে হবে। কারণ আমাদের বাহন একটি ভাঙা ট্রাক। গ্রাম থেকে গ্রামে, থেমে থেমে যেতে হবে। তা ছাড়া এখানে-ওখানে মাইন পেতে রাখা। তবু আমি, বেণু, লতা চৌধুরী, লায়লা রহমান, শারমিন মোরশেদ, বিপুল ভট্টাচার্য, স্বপন চৌধুরীসহ কয়েকজন গিয়েছিলাম। ১৫ দিন লেগেছিল পৌঁছতে। চলতি পথে খাবার বলতে ছিল পাটশাক। গোসল নেই। বাড়তি কাপড় নেই। একটা চাদর ছিল। ওটাই কম্বল। খোলা আকাশের নিচে, ট্রাকের ওপর জীবন। যেসব গ্রামে রাত কাটাতাম, সেখানকার লোকেরা খাওয়া দিত।
১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটা শুনে প্রথমে থ মেরে গেলাম। বিশে^র অন্যতম শক্তিশালী আর্মির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এ বিজয়! সবাই রাস্তায় নেমে গেছে। ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিচ্ছে। বিজয়োল্লাসে ভরে গেছে কলকাতা। আমি হাইকমিশনে গেলাম। সেখানে জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা...’ গাইলাম। তারপর ট্রামে উঠলাম। মিষ্টি খাওয়া, ফুল ছোড়া, জড়িয়ে ধরা চলল। আম্মার কথা তো সারাক্ষণই মনে পড়ত। আম্মা জানতেন, আমি আর বেঁচে নেই। আমি জানতাম, আম্মারা বেঁচে নেই। শুরু হলো দেশে ফেরার প্রচেষ্টা। কিন্তু বাস, ট্রেন কোথাও টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে ফেব্রুয়ারির ৭-৮ তারিখে লঞ্চে ফিরলাম। দেখি চারদিকে ধ্বংসের স্তূপ। এসে শুনলাম খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলা হয়েছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে আম্মার সঙ্গে দেখা হলো। কেমন যে লেগেছিল তখন বলে বোঝানো সম্ভব না। ভাই-বোন সবাই বেঁচে আছে জেনে আনন্দে চোখে পানি চলে এলো।
লেখক : শাহীন সামাদ, একুশে পদকজয়ী নজরুল সঙ্গীত শিল্পী




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close