চারিদিকে ক্যামেরার আলোর ঝলকানি,ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক আর হলরুম ভর্তি মানুষের মাঝে হালকা গুঞ্জন ছাড়া কোন শব্দ নেই। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালেফোর্নিয়ার বিশাল মিডিয়া রুমে আজ লোকে লোকারন্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ক্যামেরা তাক করা আছে একজন মানুষের মুখের দিকে। সাথে ক্যামেরার ফ্লাশ লাইটের ঝলকানি। উপস্থিত সাংবাদিকেরা কিছুটা উসখুস করছেন। সংবাদ সম্মেলনের মুল আকর্ষন যিনি, সেই শান্ত সৌম্য ভদ্রলোকটি চুপ করে আছেন। চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। একটু পর পর সাদা রুমালে চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছেন। ক্যামেরার আলোয় চিকচিক করছে তার চোখের অশ্রুকণা।
ভদ্রলোক খুব চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক হয়ে সংবাদ সম্মেলনটি শুরু করবার। কিন্তু আবেগী মানুষ তিনি, যে দেশে জন্মেছেন, লেখাপড়া করেছেন, বড় হয়েছেন সেই দেশের মানুষগুলো সবাই খুব আবেগী। বারবার ফিরে যাচ্ছেন ১বছর আগের এই দিনটিতে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ ৩জুলাই ২০২১। গত দেড় বছরে বদলে গেছে পৃথিবীর অনেক কিছু। করোনা নামক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে হার মেনে গেছে মানব সভ্যতা। মারা গেছে লক্ষ মানুষ, কর্মহীন হয়েছে কয়েক কোটি, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে ধুকছে বহু দেশ। মানুষের মনোজগতে চলে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। করোনা সংক্রমনের শুরতে বিজ্ঞানীগন যা ধারনা করেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ হয়েছে করোনা। একের পর এক করোনা ওয়েভে বিপন্ন হয়েছে মানবতা।
শুরু থেকেই এই সর্বনাশা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন খুজছিলেন বিজ্ঞানীরা। একসাথে অনেক দেশেই চেষ্টা চলছিলো ভ্যাকসিন তৈরীর চেষ্টা। ৫৬হাজার বর্গমাইলের ছোট সবুজ শ্যামল সল্পোন্নত দেশটিও করোনার সংক্রমনে বিপর্যস্ত। সেই দেশের মেধাবী একজন অনুজীব বিজ্ঞানী সপ্রনোদিত হয়ে শুরু করলেন ভ্যাকসিন তৈরীর গবেষণা। নিজ প্রতিষ্ঠানে নিজ অর্থায়নে ভ্যাকসিন গবেষণায় প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছুটা সফল হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন একটি সংবাদ সম্মেলন করে তার সফলতার কথা দেশবাসীকে জানাবেন। সংবাদ সম্মেলনে কিছুটা আবেগ সংবরন করতে না পেরে কেঁদে ফেললেন।কিছুদিন আগে প্রিয় মানুষ হারিয়েছেন করোনায়।
দিনটি ছিলো ০৩জুলাই ২০২০।
তার কেঁদে ফেলার এই ছবিটা ভাইরাল হলো। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্নভাবে ট্রল করা হলো তাকে নিয়ে। কেউ কেউ তার এই গবেষণাকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিলেন। মন খারাপ করে মেধাবী ব্যাক্তিটি যোগাযোগ করলেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে, গবেষণা চালিয়ে নিতে দরকার বড় অর্থায়নের। চিঠি চালাচালি হলো অনেক কিন্তু সরকারী বড় কর্তাদের মন গললো না। দেশী বিজ্ঞানী হিসাবে মূল্যায়ন হলো না তার। কোন রকম সহায়তা পেলেন না তিনি।
বাধ্য হয়েই পৃথিবীর সেরা গবেষনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আগ্রহ দেখালো। তিনি বেছে নিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াকে। বিশ্বের সেরা মাইক্রোবায়ালোজী ল্যাব এখানে অবস্থিত। ভগ্ন হৃদয়ে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালেন আমেরিকায়। বহুবার ডাক পেয়েছিলেন আগেই, কিন্তু দেশ ছেড়ে যেতে চাননি, ভেবেছিলেন দেশে থেকেই কিছু করবেন। কিন্তু লাল ফিতার দৌড়াত্ব, সামাজিক মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া তাঁকে বাধ্য করলো দেশ ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমানোর।
দেশ ছাড়ার পর পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন করোনা ভ্যাকসিন গবেষনায়। ১ বছর কঠোর সাধনার পর চুড়ান্ত সাফল্য হাতে ধরা দিলো। বিশ্বের ১ম শতভাগ কার্যকর করোনা ভ্যাকসিন আবিস্কার করে ফেলছেন তিনি আমেরিকার আরো দুই জন বিজ্ঞানীর সহায়তায়।
আজ ০৩জুলাই ২০২১। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হলরুমে বসে সেই ঘোষনাই দেবেন তিনি। বিশ্বের সব মিডিয়ার কেন্দ্র বিন্দুতে আজ তিনি। আমেরিকাতে গবেষনা করায় ভ্যাকসিনের প্যাটেন্ট চলে যাবে আমেরিকার হাতে, নাম হবে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের। অথচ হতে পারতো তা বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১ম কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরীতে নাম থাকতো তার প্রিয় মাতৃভূমির। আবেগী দেশের মানুষ তিনি, দেশের নামটি না আসায় আবেগ আটকাতে পারছেন না আজ, সব আবেগ আজ ঝরে পড়ছে অশ্রুকণা হয়ে...
(এটি পুরোটাই একটি কল্পকাহিনী, করো সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নন।)
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন), ঢাকা মেডিকেল কলেজ।