ই-পেপার শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

দোরগোড়ায় কোরবানির ঈদ
খামারিরা এবার চরম দুশ্চিন্তায়
প্রকাশ: রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম আপডেট: ০৫.০৭.২০২০ ২:১৬ এএম  (ভিজিট : ১৫০)
মহামারি করোনাভাইরাস সারা দেশের গরুর খামারিদের রোজগার কেড়ে নিয়েছে। টানা চারটি মাস তারা গরুর দুধ বিক্রি করে চরম লোকসান দিয়েছেন। এখন আশায় বুক বেঁধে আছেন সামনে কোরাবানি ঈদে গরু বিক্রি করে দুধের ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন এবং গরু বিক্রি করে লাভের মুখ দেখবেন। কিন্তু না, সেখানেও করোনার ভয়াল থাবা। খামারিরা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এবার কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে। কারণ যারা পশু কোরবানি দেবেন, তাদের আয় কেড়ে নিয়েছে করোনা। স্বাভাবিকভাবেই এবার কোরবানির পশুর চাহিদা কম হবে আর
চাহিদা কম হলে দাম পড়ে যাবে। সর্বোপরি সারা দেশের ৫ লাখ ২২ হাজার গবাদি পশুর খামারিকে চরম লোকসান গুনতে হবে।
ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পশুর হাটের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সারা দেশের পশুর হাটগুলোতেও হয়তো প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকেই বলা হচ্ছেÑ পশুর হাটে যেন বেশি ভিড় না করা হয় এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনেই রাজধানীসহ সারা দেশে কোরবানির পশুর হাট বসবে। কিন্তু প্রতিবার হাট ইজারা দেওয়ার আগেই গরুর ব্যবসায়ীরা সারা দেশে খামারিদের খামার চষে বেড়ান গরু কেনার জন্য, কিন্তু এবার এখনও সে চিত্র দেখা যায়নি। খামারিরা তাদের পশুগুলোকে খাইয়ে-পুষে সম্পূর্ণ বিক্রির উপযোগী করে রেখেছেন, কিন্তু গরুর ব্যাপারি বা ব্যবসায়ীদের কোনো দেখা নেই। এ কারণেই গরুর খামারিদের কপালে ভাঁজ পড়েছে, তা হলে কি এত কষ্ট করে লালন-পালন করে এবার পশুগুলো অবিক্রীতই থেকে যাবে। সেটি যতি হয় তা হলে তো চরম লোকসানে পড়তে হবে তাদের, সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত বছর কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ। চলতি বছর কোরবানিযোগ্য পশু আছে (গরু, ছাগল, মহিষ এবং ভেড়া মিলে) ১ কোটি ২০ লাখ।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আবদুল জব্বার শিকদার বলেন, গত দু-তিন বছর থেকে আমাদের কোরবানির পশু অন্য দেশ থেকে আনতে হচ্ছে না। গত বছরও ১০ লাখের মতো পশু অবিক্রীত ছিল। এর মানে আমরা গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছি। এবারও পশু চাহিদার চেয়ে বেশিই আছে। তবে আমরাও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, এবার খামারি তাদের কোরবানির পশুগুলো বিক্রি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। আমি মনে করি সারা বছর অনেক কষ্টে খামারিরা পশু পালন করে। তাই কোনোভাবেই যাতে তারা লোকসানে না পড়েন এবং পশুগুলো অবিক্রীত না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে একবার লোকসানে পড়লে পরেরবার অনেক খামারি হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে করে আমরা পশু সম্পদে যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিলাম সেটি বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশ প্রাণিসম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর থেকে ভারতীয় গরুর অনুপ্রবেশ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। আগে প্রতিবছর ২৪-২৫ লাখ ভারতীয় গরু আসত। ২০১৯ সালে মাত্র ৮৫ হাজার গরু ঢুকেছে দেশে। গত বছর সারা দেশে কোরবানিযোগ্য ৪৫ লাখ ৮২ হাজার গরু-মহিষ, ৭২ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ৬ হাজার ৫৬৩টি অন্যান্য পশুর কোরবানিও হয়েছে। আসন্ন ঈদুল আজহায় ১ কোটির বেশি পশুর কোরবানি হওয়ার প্রত্যাশা আছে।
একেকজন খামারি লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন কেবল কোরবানির ঈদকে লক্ষ্য রেখে। কেউ নিজের জমানো টাকা বিনিয়োগ করেন, আবার কেউ ব্যাংক ঋণ নিয়েও বিনিয়োগ করেন। এত টাকা বিনিয়োগ করে যদি কোরবানির ঈদে গরুর দাম ভালো না পায় তা হলে খামারিদের দুঃখের সীমা থাকবে না। গরু পালন করতে গিয়ে অনেকের লোন হয়েছে। ধারদেনা করে কোরবানির আশায় গরু পালন করেছে অনেকে। এসব খামারি করোনার বর্তমান অবস্থায় এখন আতঙ্কের মধ্যে আছে।
সময়ের আলোর কুষ্টিয়া প্রতিনিধি ইসমাইল হোসেন জানান, করোনা দূর্যোগে কোরবানির পশু নিয়ে লোকসানের শঙ্কায় কুষ্টিয়ার ৩৮ হাজার খামারি। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ী গ্রামের কৃষক ছাইদার আলী, গত বছর কোরবানি ঈদ উপলক্ষে তিনটি গরু পালন করে নিয়ে যান রাজধানীর ঢাকার গাবতলী গরুর হাটে। ভালো দাম না পেলেও খুব একটা লোকসান গুনতে হয়নি তার। সেই গরু বিক্রির টাকা দিয়ে এবারের কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে ২ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন চারটি গরু। প্রায় এক বছর লালন-পালন করছেন গরুগুলোকে। এরই মধ্যে আরও প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ করেছে তিনি এই গরুর পেছনে। আশা ছিল চারটি গরু এবার কমপক্ষে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি করবেন তিনি। কিন্তু তার সেই আশা এখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাবে বলে তিনি জানান। চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারেন না। ঘরে তার বিয়ে উপযুক্ত মেয়ে। ইচ্ছে আছে এই গরু বিক্রির টাকায় এবার মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন করবেন। কিন্তু দেশের বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে অতি আশার সেই চারটি গরু নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। শুধু ছাইদার আলীই নন, একই অবস্থা কুষ্টিয়া জেলার প্রায় ৩৮ হাজার ছোট-বড় গরু-ছাগলের খামারিদের।
কোরাবানি ঈদকে সামনে রেখে কুষ্টিয়া জেলায় যে পরিমাণে গরু এবং ছাগল প্রস্তুত করা হয় তা দেশের চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করে। এই এলাকায় শুধু কোরবানির চাহিদার কথা মাথায় রেখে শহর থেকে শুরু করে প্রতিটি গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই ১ থেকে একাধিক গরু-ছাগল এবং খামারে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু পালন করা হয়। তাই ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে কুষ্টিয়ার খামারিদের দুশ্চিন্তা ততই বেড়ে চলেছে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে জেলার প্রায় ৩৮ হাজার ছোট-বড় খামারে ১ লাখ ৫ হাজার গরু এবং প্রায় ৭০ হাজার ছাগল প্রস্তুত করা হয়েছে। এ ছাড়া আছে ভেড়া এবং মহিষÑ সব মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ পশু দেশের বিভিন্ন স্থানের হাটে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সিদ্দিকুর রহমান জানান, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে খামারিরাও একটু বিপাকে আছে। তবে সরকারিভাবে তাদের প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব না হলেও কীভাবে লস পুষিয়ে খামারিদের সাহায্য করা যায় সে ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বড় খামারিরা যাতে সহজে ব্যাংক লোন পান সে ব্যাপারেও সহযোগিতা করার আশ^াস দেন ওই কর্মকর্তা।
সময়ের আলোর মেহেরপুর প্রতিনিধি তৌহিদ উদ দৌলা রেজা জানান, মেহেরপুরে কয়েক হাজার খামারি স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে করোনার মধ্যে শখের গরু বিক্রি করতে বেশ চিন্তায় পড়েছেন। জেলার চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত থাকবে কোরবানির পশু। বর্তমান বাজারমূল্যে গরু-ছাগল বিক্রি করলে খামারিরা প্রায় ১শ কোটি ২১ লাখ ৯২ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্তের আশঙ্কা। মেহেরপুরসহ পাশর্^বর্তী চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া লকডাউন হওয়ায় পশুহাট বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তারা গরু বিক্রি করতে পারেননি। আবার ঢাকায় পশুর হাট বসা নিয়েও বেশ শঙ্কায় রয়েছেন। গরু ন্যায্যমুল্যে বিক্রি করতে না পারলে লোকসান গুনতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। শুধু খামারি নয়, ব্যবসায়ীদেরও চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে শখের গরু নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়েছেন মেহেরপুরের খামারিরা। হরিরামপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম নিজের সঞ্চয় ও ব্যাংক লোন নিয়ে ছোট একটি খামার করেছিলেন। এখন সাতটি গরুর মধ্যে চারটি গরু কোরবানির জন্য উপযুক্ত। যদি চারটি গরুর দাম ২০ লাখ টাকা হয় তা হলে লাভবান হবে। তবে বর্তমানে কোনো ব্যবসায়ী আসছে না। অন্য বছর এ সময় ব্যবসায়ীরা গরু কেনাবেচা শুরু করত। এবার কোনো ব্যবসায়ী আসেনি। করোনার কারণে ঢাকায় কোরবানির হাট বসবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় পড়ে ব্যাবসায়ীরা গরু কিনতে আসছে না। ন্যায্যমুল্যে গরু বিক্রি করতে না পারলে অনেক বেশি লোকসান গুনতে হবে তাকে।
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব মতে, জেলার নিবন্ধনকৃত খামার ও পারিবারিকভাবে ৩০ হাজার ৯০৪টি খামারে পালন করা ১ লাখ ১ হাজার ২০টি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নেপালি, হরিয়ান ছাড়াও দেশি জাতের গরু প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পালন করছে খামারিরা। খাবারের চড়া দামের কারণে পশু পালনে বেশ খরচ হচ্ছে খামারিদের। খামারিদের স্বপ্ন, কোরবানির ঈদে গরু বিক্রি করে সব ঋণ পরিশোধ করে আবার নতুন করে গরু কিনে পালন করবে। এলাকার অনেক বেকার ও শিক্ষিত যুবক চাকরি না করে পশু পালন করছে। তবে কাক্সিক্ষত মুল্য না পেলে খামারিরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে দুয়েকটি গরু পালন করছে তারাও পুঁজি হারাতে পারে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, জেলায় কোরবানি উপযোগী গরু ও মহিষের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৮২টি এবং প্রতিটি গরুতে বর্তমান বাজারমূল্যে ২০ হাজার টাকা লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে লোকসানের পরিমাণ ৭৪ কোটি ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৬৩ হাজার ৬৩৮টি। প্রতিটি ছাগলের বাজারমূল্যে লোকসান ৪ হাজার টাকা। ছাগল খামারিদের লোকসান ২ কোটি ৪৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ১শ কোটি ২১ লাখ ৯২ হাজার টাকা ক্ষতির আশঙ্কা মেহেরপুরের খামারিদের।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, জেলায় পালিত পশুর মধ্যে ৫০ ভাগ জেলায় জবাই করা হয়। বাকি অর্ধেক সরাসরি এবং বিভিন্ন হাটের মাধ্যমে ঢাকার কোরবানির পশু হাটে তোলা হয়। বিক্রির জন্য পশুর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা দিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ অফিসের কয়েকটি টিম। খামারি ও গরু পালনকারীদের উৎসাহ দিতে সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে পশুর ন্যায্যমুল্য নিশ্চিত করতে মাঠে রয়েছে। তবে খামারিরা ন্যায্য মূল্যে পেলে লাভবান হবে এবং আগামী দিনে খামারির সংখ্যা বাড়বে।
এদিকে করোনার কারণে গো-খাদ্যের দামও চড়া হয়েছে। এক মাস আগে এক বস্তা (৩৭ কেজি) গমের ভ‚সির দাম ছিল ১১শ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪শ টাকা। শুধু গমের ভ‚সি নয়, সব গো-খাদ্যের দাম গড়ে ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। পরিবহন সঙ্কটে গো-খাদ্যের অভাবও দেখা দিয়েছে। বড় বড় খামারে সঙ্কট দেখা দিয়েছে গরু পরিচর্যাকারী শ্রমিকেরও। এসব কারণেও চরম সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে খামারিদের। তার ওপর যদি কোরবানির পশুগুলোকে বিক্রি করতে না পারে, তা হলে খামারিদের পথে বসতে হবে।








সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close