ই-পেপার শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

করোনার কশাঘাতে এবার পেশা বদল
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০২০, ১১:৫৮ পিএম আপডেট: ০৭.০৭.২০২০ ২:৩১ এএম  (ভিজিট : ২৩৭)
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বাসিন্দা কবীর হোসেন দীর্ঘ ১২ বছর চাকরি করতেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ায়। মার্চ থেকে মেÑ তিন মাস বেতন হয়নি তার অফিসে। তাই বাসাভাড়াও দিতে পারেননি তিনি। এ অবস্থায় ঢাকায় টিকে থাকা দায়, তাই বাধ্য হয়ে জুনের এক তারিখে শেওড়াপাড়ার বাসা ছেড়ে সব কিছু গুছিয়ে তিনি চলে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু এতদিন পর গ্রামে এসে তিনি কি করবেন, কীভাবেই বা সংসার চালাবেনÑ সে চিন্তায় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। পরে গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে তিনি বেশ কিছু টাকা ধার নিয়ে তার নিজ গ্রাম আমলায় মুদির দোকান দিয়েছেন। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন শেষে যে চাকরি করতেন এতদিন সেটি ছেড়ে পেশা বদলে তিনি এখন হয়েছেন মুদি দোকানদার।
এ চিত্র এখন শুধু একজন কবীর হোসেনের নয়। মহামারি করোনাভাইরাস এ রকম লাখো কবীরের আয়-রোজগার কেড়ে নিয়েছে। পরে বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। এই যেমন ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। তিনিও সম্মানজন পদে চাকরি করতেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে। করোনার কারণে আর্থিক টানাপোড়েনে চাকরি ছেড়ে তিনি এখন হয়েছেন সবজি ব্যবসায়ী। করোনায় সবচেয়ে বেশি পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা। কারণ করোনায় সব কিছু খোলা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই ১৬ মার্চ থেকে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ। এই দীর্ঘ সময়ে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের বেতন দেওয়া বন্ধ, ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনও বন্ধ রয়েছে। কারণ শিক্ষার্থীদের দেওয়া মাসিক বেতনের ওপর নির্ভর করেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে। অর্ধাহারে, অনাহারে আর কতদিন থাকা যায়, তাই এসব শিক্ষক-কর্মচারী পেশা বদলাচ্ছেন বেশি। শিক্ষকতা ছেড়ে কেউ হচ্ছেন হকার, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আবার কেউ গ্রামে গিয়ে করছেন কৃষিকাজ।
করোনায় কর্মহীন মানুষের সংখ্যা নিয়ে সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে। সে তথ্য অনুযায়ী কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ১৪ লাখ। এর বেশিরভাগই এখনও বেকার, আর কিছু লোক পেশা বদলে অন্য কাজ ধরেছেন। তবে তাদের জীবনমান কমে গেছে। কারণ দলানো পেশা তাদের আগের মতো আয় হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা খরচ কমাচ্ছে। আগে হয়তো ২০ হাজার টাকার ভাড়া বাসাতে থাকতেন, এখন থাকছেন ৮ বা ১০ হাজার টাকার ভাড়া বাসায়। তা ছাড়া এসব ভুক্তভোগী মানুষ তাদের প্রতিদিনকার খাবার খরচও কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থাৎ এই সঙ্কটকালীন সময়ে তারা কোনো রকম খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বলছেন, করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। অনেকেই আগের স্বচ্ছল জীবনযাপন থেকে এখন গরিবানা জীবনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, করোনার কারণে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। আগে তাদের জীবনযাপন ছিল এক রকম, আর এখন আরেক রকম। দেশের অর্থনীতি যদি ঠিক না হয়, তাহলে এই বেকারের সারি আরও দীর্ঘ হবে। চীন হয়তো খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটা আরও দীর্ঘ হবে। কারণ বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বা শিল্প মালিকরা তো করোনা পরিস্থিতি কি হয় তা না দেখে তাদের কারখানা খুলবে না, বা অফিস চালু করবে না। সুতরাং এ ধরনের সঙ্কট সহসায় মিটবে না।
তিনি বলেন, এখন কথা হচ্ছেÑ এ অবস্থায় সরকারের কি করণীয় আছে। হ্যাঁ, একমাত্র সরকারই পারে হঠাৎ সঙ্কটে পড়া দেশের এই অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। কীভাবে দাঁড়াতে হবে সেটি আমরা এই নতুন অর্থবছরের বাজেটের আগেই একটি ধারণা দিয়েছিলাম সরকারকে। আমরা সরকারকে বলেছিলাম, বিভিন্ন খাতের জন্য যেমন সব মিলে প্রায় ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার, ঠিক তেমনি শুধু চাকরি হারানোদের জন্য আলাদা একটি সহায়তা প্যাকেজ সরকারের ঘোষণা করা দরকার ছিল। কিন্তু সরকার আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করেনি। তবে এ ধরণের উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে এখনও নেওয়া যেতে পারে।
করোনার কারণে যে কেবল চাকরিজীবীরা পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন তেমনটি নয়, ক্ষুদ্র-মাঝারি এমনকি অনেক বড় ব্যবসায়ীও তাদের দীর্ঘদিনের ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ লোকসান দিতে দিতে তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। যেমন ঢাকার মোহাম্মদপুরের নিউওয়ে স্টুডিওর মালিক জুলফিকার আলী। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি স্টুডিওর ব্যবসা করছেন। কিন্তু গত চার মাস একাধারে লোকসান দিতে দিতে তিনি পুঁজিপাট্টা শেষ করে ফেলেছেন। শেষ তিন মাস তো দোকান ভাড়ার মাসিক ২০ হাজার টাকাই তোলা যেত না। বাধ্য হয়ে তিনি তার সাধের স্টুডিওটা বন্ধ করে দিয়ে গ্রামের বাড়ি রাজশাহী পাড়ি জমিয়েছেন।
আবুল কালামের পেশা বদলের গল্পটা বেশ করুণ। ২ লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে তিনি রাজধানীর ফার্মগেটে সুপারভিউ মার্কেটের করিডোরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বেশ ভালোই আয় হতো তার। সে আয় দিয়েই চলত ছয়জনের সংসার। বসবাস করতেন রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায়। ১০ এপ্রিল তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে টানা ২৫ দিন চিকিসাধীন ছিলেন। এতে খরচ হয়ে গেছে এক লাখ টাকা। আর এই তিন মাস তার আয়-রোজগার একেবারে বন্ধ। তিন মাস বাসাভাড়া দিতে পারেননি, কিন্তু তিনি যে বাসায় থাকেন তার মালিক বেশ কর্কশ। কোনো রকম এক মাসের ভাড়া পরিশোধ করে, বাকি দুই মাসের ভাড়া মাফ চেয়ে বাসাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এখন একই মহল্লায় সাত হাজার টাকা ভাড়ায় টিনশেডের দুটি রুম নিয়ে সবাইকে নিয়ে উঠেছেন। কিন্তু কীভাবে টিকে থাকবেন এই শহরে, কীভাবেই জুটবে প্রতিদিনকার খাবার। বেশি পুঁজিও নেই যে আবার কাপড়ের ব্যবসাটি শুরু করবেন। তবে হ্যাঁ, ব্যবসা তিনি আবার শুরু করেছেন, তবে কাপড়ের নয়, এখন তিনি মহল্লায় একটি ঝুড়িতে করে মাথায় বহন করে সবজি বিক্রি করছেন। তার পেশা বদলের গল্পটি বলতে গিয়ে তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
করোনায় সবচেয়ে বেশি পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন বেসরকারি স্কুল-কলেজ এবং কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা। দীর্ঘদিন লকডাউন ও সাধারণ ছুটির পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড-সংশ্নিষ্ট প্রায় সব প্রতিষ্ঠান খুলেছে। কিন্তু করোনার প্রভাব না কমায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ৬ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ছুটি বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ দীর্ঘ ছুটির কারণে উল্লেখযোগ্য শিক্ষকই পড়েছেন বিপাকে। বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত নন এমন অন্তত ১৪ লাখ শিক্ষক ও তাদের পরিবারে নেমে এসেছে দুর্দিন। এর ফলে পেশা বদলাচ্ছেন শিক্ষকরা। বাঁচার তাগিদে শিক্ষকরা অন্য পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। যেমন রাজধানীর কাজীপাড়ার কসমিক কিন্ডারগার্ডেনে শিক্ষক শফিকুল ইসলাম। করোনায় তার স্কুলটি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। বাঁচার তাগিদে তাই তিনি এখন ফুটপাথের হকার হয়েছেন। ফুলবাড়ীয়া থেকে কম দামি স্যান্ডেল কিনে এনে তিনি বিক্রি করে কোনোরকম সংসার চালাচ্ছেন। শিক্ষক থেকে তিনি এখন জুতা বিক্রেতা।
নিজের পেশা বদলেছে ২৫ বছরের যুবক মো. আলী হোসেন। তার বাবা বেঁচে নেই।  ছোট ভাই-বোন আর মাকে নিয়ে সংসার। একটি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে চলত হৃদয়ের সংসার। উৎপাদন ভিত্তিতে মজুরি। ২৬ মার্চ করোনাভাইরাসের কারখানা বন্ধের পর থেকে ঘরে বসেই কেটেছে। সঞ্চয় ফুরোনোর পর মে মাস থেকে মহল্লায় রিকশা চালাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, কারখানায় চাকরি করে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতাম। সে টাকা দিয়ে আমাদের সংসারটা বেশ ভালো চলে যেত। কিন্তু চাকরিটা চলে যাওয়ার পর কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটা সময় এমন অবস্থা হলোÑ ঘরে কোনো খাবার নেই, পকেটেও টাকা নেই। তাই বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে রিকশা নিয়ে পথে নেমেছি।






সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close