ই-পেপার শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আশঙ্কার নীতি
প্রকাশ: সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম  (ভিজিট : ৯২১)
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে বেশ কিছু কথাবার্তা হচ্ছে এবং এর অধিকাংশই অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, সেই সাথে হতাশাজনক তো বটেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিশেষজ্ঞরা যখন রাষ্ট্রগুলোকে এই ধারণা থেকে বিরত থাকবার আহ্বান জানিয়ে আসছেন, তখন যারা হার্ড ইমিউনিটির পক্ষে অনেকগুলো যুক্তি তুলে ধরছেন, তাদের সেই যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে অর্থনীতি, বাণিজ্য, সমাজব্যবস্থা, মানুষের বিহেভিওরিয়াল ব্যাপারগুলো আলোচিত হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিই কিন্তু একেবারে উপেক্ষিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘জীবন’। এটি কেবল হতাশার কথা তা-ই নয়, এর চেয়ে বড় উদ্বেগের আর কিছু এ মুহূর্তে হতে পারে না।
আমাদের দেশে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই কি তাদের জীবন এত মূল্যহীন?
‘হার্ড ইমিউনিটি’র কার্যকারিতার ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে এটি কীভাবে কাজ করে তা সংক্ষেপে বলা যাক। কোনো একটি অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ যখন একটি ভাইরাসের প্রতি ইমিউন বা প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন বলা যায়, ওই বিশেষ জনপদটি সামষ্টিকভাবে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্জন করেছে। তখন কোনো একজন ব্যক্তি যদি আক্রান্ত হয় তবে সে যাদের সংস্পর্শে আসে তাদের অধিকাংশই যেহেতু আগে থেকে ইমিউন তাই রোগটি আর খুব বেশি মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে না।
এটি প্রধানত দুইভাবে অর্জিত হতে পারে। প্রথমত এবং সবচেয়ে কার্যকরী উপায়টি হচ্ছে ভ্যাকসিনের ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যামে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউন করে তোলা। এতে করে যে সামান্য অংশ ভ্যাক্সিনেটেড হ নি, তারাও একটি গোষ্টীগত সুরক্ষা পায় (কমিউনিটি ইমিউনিটি)। দ্বিতীয়ত, যদি জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ আক্রান্ত হবার পরে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং যদি তাদের দেহে এই ভাইরাসের প্রতি একটি দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) তৈরি হয়। এতে করে জনসংখ্যার বাকি অংশ যারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করেনি তাদের ভেতরেও রোগটি ছড়ানোর আশঙ্কা হ্রাস পায়।
সাধারণত একটি দেশের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ যখন সংক্রমিত হয়ে যায় তখন দেশটি হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছায়। তবে এইসংখ্যাটা একেবারে বিবলিকালি সত্য নয়, কোন মহামারি কতটা সংক্রামক তার ওপর নির্ভর করে এই সংখ্যাটাও কমবেশি হতে পারে। হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে আমাদের ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগকে (অথবা আরও বেশি) করোনাতে আক্রান্ত হতে হবে। শুধু তাই নয়, যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে পুরোপুরি করোনা প্রতিরোধীও হয়ে উঠতে হবে। ব্যপারটা একই সাথে ফ্যান্টাসি এবং হররের সংমিশ্রণ। ফ্যান্টাসি এ কারণে যে আমাদের কাছে এখনও কোনোরকম তথ্যপ্রমাণ নেই যেটা দাবি করে যে একই মানুষ একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হতে পারে না। অন্যদিকে হরর বা ভয়াবহ এ কারণে যে আমাদের ১৮ কোটি মানুষের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ মানুষ বলতে কিন্তু বোঝায় একটি অবিশ্বাস্য রকমের বড় সংখ্যা। যদি করোনা আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫ ভাগকেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং শতকরা ১ ভাগ মৃত্যুবরণ করে তবে সেই সংখ্যা কত ভয়াবহ হবে সেটা সহজেই বোধগম্য। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতার কথা চিন্তা করলে এই ভয়াবহতাটা আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়।
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে যদি প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার করোনা আক্রান্ত হয় তবুও হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে ২০২১ সালেরও অনেকখানি সময় পেরিয়ে যাবে। অন্যদিকে স্পেনে একটি দেশব্যাপী জনসংখ্যা ভিত্তিক গবেষণায় উঠে আসে, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ করোনা আক্রান্ত। স্পেনে কোভিড-১৯-এর উচ্চ সংক্রমণ থাকা সত্ত্বেও তা হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য স্পষ্টভাবে অপর্যাপ্ত। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মৃত্যু ব্যতীত কোনোভাবে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব নয়। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, ভ্যাকসিন ছাড়া হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের চেষ্টা একই সাথে ‘ভীষণ অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য’।
ব্রিটেন প্রথমদিকে হার্ড ইমিউনিটি এই বিপজ্জনক কথা ভেবেছিল কিন্তু তারা পরবর্তীতে এই ভয়ঙ্কর চিন্তা থেকে সরে আসে। হার্ড ইমিউনিটির জন্য সুইডেনের উদাহরণ অনেকে ব্যবহার করেন। সুইডেন অনেক স্বল্প জনসংখ্যার একটি দেশ বলে পারসন-টু-পারসন সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি কম ছিল। তা ছাড়া সে দেশের জনগণও অনেক সচেতন। কিন্তু তাদের এই উলটো পথের যাত্রা ১ কোটি জনসংখ্যার এ দেশটিতে পরবর্তীতে বিপদ ডেকে এনেছে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর (যেসব দেশে লকডাউন ছিল) তুলনায় জনসংখ্যার বিচারে অপেক্ষাকৃত বেশি মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগত্বত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. মারিয়া ভ্যানকারকোভ তাই সরকারগুলোকে বারবার সাবধান করছেন অপেক্ষা করবার জন্য। একটা কার্যকরী ওষুধ বা ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের এখনও দ্বিতীয় কিছু ভাববার সময় আসেনি।
হার্ড ইমিউনিটির কথা বললে জনগণ বিভ্রান্ত হবে। পাশাপাশি যারা এতদিন সোশ্যাল ডিসটেন্সের নিয়ম মেনে চলছিল তারাও নিয়মের প্রতি উদাসীন হবে। কাজেই হার্ড ইমিউনিটির কথা না বলে আমাদের উচিত হবে :
১. দেশ জুড়ে টেস্ট করার পরিমাণ আরও বাড়ানো। টেস্ট করে পাওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ট্রেসিং করতে হবে। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির টেস্ট পজিটিভ আসার আগে তার দ্বারা যারা সংক্রমিত হতে পারে তাদের চিহ্নিত করা। এভাবে ট্রেসিং করে ঝুঁকির মাঝে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের জানাতে হবে এবং কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।
২. জোনিংয়ের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. গার্মেন্টস, শপিংমলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিসিনফেক্ট্যান্ট ব্যবহার, প্রবেশের পূর্বে তাপমাত্রা পরীক্ষা করা, স্যানিটাইজার সরবরাহ এবং ব্যবহার করা, কেউ অসুস্থ হলে নোটিফাই করা বাধ্যতামূলক করা, দুজন কর্মচারীর মাঝে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখা) তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব নীতি মেনে না চললে জরিমানাসহ শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. জনগণের মাঝে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং এবং হাইজিনের (হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মাস্ক ব্যবহার করা) চর্চা করার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করতে হবে, তবে তাও হতে হবে নিয়ম মেনে। আমরা অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দেখেছি ৫০ ব্যাগ রিলিফ দিতে শতাধিক মানুষের বহর নিয়ে শোডাউন করতে, এতে জনস্বাস্থ্য আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
৫. অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখার জন্য চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশই করোনার বিরুদ্ধে লরছে, যার যা কিছু আছে সবটুকু সম্বল নিয়ে। বাংলাদেশেরও লড়াই চলছে, তবে এখনই কোনোভাবেই হাল ছাড়বার সময় নয়।
লেখক : ডা. শাহরিয়ার রোজেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র পলিসি লিড, আলবার্টা, কানাডা;
মুহম্মদ রিজওয়ানুর রহমান, প্রকৌশলী ও পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা;
নাফিসা নীড়, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, জনস্বাস্থ্য ও তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়








সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close