ই-পেপার শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

বরিশাল পুলিশের সঙ্গে প্রতারক চক্রের সখ্য ওসি-এসআই করেন মামলা মীমাংসা
ডিসি বললেন, এ মামলা আপসরফার সুযোগ নেই
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম আপডেট: ৩১.০৭.২০২০ ৪:০৩ এএম  (ভিজিট : ১২০)
পুলিশের সঙ্গে প্রতারক চক্রের সখ্যের ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে বরিশালে। পাবনা থেকে আমদানি করা প্রায় তিন লাখ টাকার মুরগি আত্মসাতের লক্ষ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে একটি চক্র ধরা পড়ার পর বরিশাল পুলিশ তাদের রক্ষায় এক নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
মুরগির মূল মালিক পুলিশের অসহযোগিতার একপর্যায়ে নিজেই সমুদয় চালান উদ্ধার করেন। কিন্তু এ ঘটনায় মামলা করা হলেও ২ প্রতারককে পুলিশ গ্রেফতার না করে উল্টো পাবনার ব্যবসায়ীর সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি করে। মুরগির মালিক পাবনার রেজাউল ইসলামকে প্রাপ্ত টাকা বুঝিয়ে দিয়ে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। রেজাউল কৌশলে বরিশাল ছেড়ে নিজ এলাকা পাবনায় এখন এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।  
মুরগি আমদানির নামে আত্মসাৎ চেষ্টার সঙ্গে জড়িত জালাল ও বাদল প্রকৃত অর্থেই প্রতারক চক্র গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে মুরগির অর্ডার দিয়ে বরিশালে নিয়ে এসে টাকা না দিয়ে তারা আত্মসাৎ করে থাকেন। তাদের এ প্রক্রিয়া বড়ই নাটকীয়তাপূর্ণ।

সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দর থানা পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত হলেও এখন তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে অর্থনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, পাবনার ওই ব্যবসায়ীর করা মামলাটি প্রত্যাহারে প্রতারক চক্রের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা পুলিশ প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে।
এই প্রতারণা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ইলিয়াস গোটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার মূল নায়ক হিসেবে ভূমিকা রেখে থানার ওসিকে ম্যানেজ করে প্রতারকদের রক্ষায় কৌশল নেন।
বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে এ প্রতিবেদক এসআই ইলিয়াসের কাছে এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি মামলার আসামিদের অনুপস্থিতিতে কীভাবে বাদীর সঙ্গে আপসরফার নথি তৈরি করলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একটি আইনি যুক্তি দাঁড় করান।
কিন্তু উল্টোদিকে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি/উত্তর) খাইরুল আলম তার সহকর্মী ইলিয়াসের এই ব্যাখ্যা এবং প্রতারক চক্রের সঙ্গে পুলিশের সখ্যের বিষয়টি জেনে বিস্মিত হন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কান পর্যন্ত ঘটনা গড়ানোর কারণে বিপাকে পড়েছে বিমানবন্দর থানার পুলিশ।
প্রতারক জালাল ও বাদল বরিশাল শহরের রূপাতলী এলাকার মুরগি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। গত বৃহস্পতিবার দুই ব্যক্তি নিজেদের পরিচয় আড়াল রেখে এদের ১ জন নিজেকে সিরাজ নামে পরিচয় দিয়ে সেলফোনের মাধ্যমে পাবনার বৃহৎ ব্যবসায়ী রেজাউলের কাছে ৫৬০টি মুরগি অর্ডার করেন। চুক্তিস্বরূপ পণ্য বরিশালে আসার পর অর্থ পরিশোধের কথা ছিল। আলোচনা সাপেক্ষে রেজাউল একটি ট্রাকে করে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকার মুরগি বরিশালের উদ্দেশে নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে গত শুক্রবার ভোর রাতে বরিশাল নগরীর প্রবেশদ্বার গড়িয়ারপাড়ে মুরগিভর্তি ট্রাকটি পৌঁছালে কোন এক ব্যক্তি নিজেকে সিরাজ পরিচয় দিয়ে রেজাউলের সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ট্রাকটির গতিরোধ করে এবং অন্য একটি ট্রাকে মুরগিগুলো তুলে নিয়ে যায়।
পাবনার ওই ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে জানান, বরিশাল নগরীতে বহিরাগত ট্রাক প্রবেশ করলে ট্রাফিক বিভাগ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন ধুয়া তুলে বাদল ও জামালের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ট্রাকে মুরগিগুলো তুলে নিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে দ্রæত নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
মূলত সিরাজকে না চেনায় বুঝে উঠতে পারেননি তিনি প্রতারণার শিকার হতে যাচ্ছেন। প্রতারণার বিষয়টি নিশ্চিত হলে এই অঞ্চলে তার কাছ থেকে মুরগি আমদানিকারী বেশ কয়েকজনের কাছে এ ঘটনা তুলে ধরে মুরগির সন্ধান শুরু করেন। পাশাপাশি ঘটনাসংশ্লিষ্ট বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন। কিন্তু বিষয়টি আমলে না নিয়ে তাকে অসহযোগিতা শুরু করে বিমানবন্দর থানার পুলিশ। ঘটনাচক্রে রেজাউল জানতে পারেন তার মুরগির চালান রূপাতলীর দুই ব্যবসায়ীর কাছে রয়েছে। পরক্ষণে একদিনের মাথায় শনিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি সমুদয় মুরগি শনাক্ত করেন এবং বাদল-জালাল যে প্রতারক সে বিষয়ে ধারণা পেয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি থানা পুলিশকে তার পণ্য উদ্ধারে সহায়তা চান।
পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে বাদল-জালাল বিষয়টি ঘুরিয়ে সেই কথিত সিরাজের কাছ থেকে ক্রয় করার কথা জানান। কিন্তু মুরগির অর্থ পরিশোধে সম্মতি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
অবশ্য ব্যবসায়ী রেজাউল বরিশালের এই দুই ব্যবসায়ীর কৌশল আঁচ করতে পারলেও অর্থ উদ্ধারের আশায় বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল চোরাই পণ্য রাখার দায়ে কেন বাদল-জালালকে আটক করা হলো না। এই রহস্য ভেদের মাঝেই পুলিশের মধ্যস্থতায় দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা রেজাউলকে দেওয়ার পর মামলাটি প্রত্যাহারে তাকে চাপ দিলে প্রকাশ পায় এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে পুলিশের আগেভাগেই সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ মামলার তদন্তে গিয়ে প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েও নিরব ছিল।
বিস্ময়কর বিষয় হলো বিমানবন্দর থানায় বসে রেজাউলকে মুরগির সমুদয় অর্থ পরিশোধ করা হলেও মামলায় অভিযুক্ত কথিত সেই সিরাজকে সামনে আনা হয়নি। তাকে অন্তরালেই রাখা হয়েছে। পরে এসআই ইলিয়াস মামলাটি প্রত্যাহার করে দেওয়ার চাপ দিয়ে ব্যবসায়ী রেজাউলের কাছ থেকে একটি স্বাক্ষর নেন। এবং সেই দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে রাখেন।  থানায় বসে এই আনুষ্ঠানিকতা ওসি জাহিদ বিন আলম প্রত্যক্ষ করলেও তিনি সমঝোতার নির্দেশ দিয়ে দূরত্ব বজায় রাখেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, কথিত প্রতারক সিরাজের আসলে কোন অস্থিত্ব নেই। মূলত বাদল ও জালালই সিরাজ নামটি ব্যবহার করেছে প্রতারণার কৌশলস্বরুপ। থানার ওসি ও মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ইলিয়াস বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায়ার পরেও বাদল-জালালের সঙ্গে সমঝোতাস্বরূপ মামলাটি প্রত্যাহারের সন্ধিচুক্তি করেন। সেক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মামলার আসামি পাওয়া সত্তে¡ও তাদের গ্রেপ্তার না করে সমঝোতার নাটক তৈরি করায় প্রমাণিত হয় বরিশাল পুলিশের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারক চক্রের সখ্য রয়েছে, নচেৎ এত বড় ধরনের ঘটনা চেপে যাওয়ার মানে কী? এমন প্রশ্ন এসআই ইলিয়াসের কাছে তোলা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যেতে নানা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে ওসিও তাকে সমর্থন দেন। কিন্তু মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার খাইরুল আলম বলেন, এ ধরনের আপসের কোন সুযোগ নেই।
তিনি ঘটনাটি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। সর্বশেষ বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, এ ঘটনা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মিডিয়াকর্মীরা অবগত হওয়ায় বিমানবন্দর থানা ওসি-এসআই ইলিয়াসের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এখন বিষয়টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে সেই রেজাউলকে সহায়তা দেওয়ার নতুন প্রতিশ্রæতি দিয়ে তিনি পাবনায় যোগাযোগ শুরু করেছেন।
কিন্তু ব্যবসায়ী রেজাউল বরিশালে নাজেহাল ও পুলিশের অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণের কারণে তার নিজ এলাকার আদালতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিমানবন্দর থানা পুলিশও মামলা মোকাদ্দমায় জড়িয়ে যেতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।





সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close