’৫২-র ভাষা আন্দোলনেই বঙ্গবন্ধুর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেতনা প্রোথিত হয়। সে থেকেই নিপীড়িত জাতির মুক্তির জন্যই তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের নির্দেশনা স্পষ্ট করেছেন, তিনি বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাইÑ আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’ এই ভাষণে আরও উল্লেখ্য রয়েছে, ‘বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবা না।’ অর্থনৈতিক মূল্যবোধ ও মননর্চচার সামগ্রিক মুক্তির ইঙ্গিত দিয়েই বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। সে থেকেই তার প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশ। আধুনিক এই দেশের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য যার আধুনিক চিন্তা-চেতনা প্রতিফলিত হচ্ছে সর্বত্রই। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি কেরানি নয়, কর্মঠ জাতি গঠনে দিয়ে গেছেন আধুনিক সময়োপযোগী শিক্ষানীতি। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে শিক্ষা খাতকে তিনি আধুনিকায়নে মেধামনন প্রয়োগ করেছেন। এক সময়ের মুষ্টিচালে পরিচালিত দেশের মাদ্রাসাগুলোকে যিনি সম্মানী ভাতার আওতায় এনে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন। সনাতনী কওমি মাদ্রাসার শিক্ষায় যুক্ত হয়েছে আধুনিক চিন্তা-চেতনা।মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান তাঁরই অবদান। স্বাধীন দেশের পবিত্র সংবিধানে জাতির কর্ম-কল্যাণের গভীর চিন্তা প্রস্ফুটিত হওয়ায়, আজ উন্নত বিশে^র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো সক্ষম বাংলাদেশ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে পারাপারে বাঁশের সাঁকো, কাঠের ব্রিজের পরিবর্তে এখন অত্যাধুনিক উন্নত ব্রিজ, কালভার্ট, সর্বোপরি দৃষ্টিনন্দন পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। মানুষের নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। সুশাসন নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সুফল বর্তমান জাতি ভোগ করছে। কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকায়নে প্রান্তজনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে কৃষকদের ব্যবহার আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, ন্যায্যমূল্যে উন্নত কৃষিবীজ ও সার-কীটনাশক। এক সময়কার অভাব অনটনের এই ভূখণ্ড বর্তমান উন্নয়নের মহাসড়কে। যোগাযোগ ক্ষেত্রে জাতির পিতার চিন্তা-চেতনা প্রতিফলিত হওয়ায় রাস্তাঘাট, স্থলপথ, নৌপথ, আকাশপথে স্বাধীন দেশের সঙ্গে পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশের যোগাযোগ এখন হাতের মুঠোয়। চা শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন এগিয়ে চলছেই। পর্যটন শিল্পের প্রসার দিন দিন ঊর্ধ্বগামী। হ্যারিকেন, কুপিবাতির এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা ভোগ করছেন বৈদ্যুতিক আলো। এক সময়কার কবুতরের পায়ে বাঁধা কিংবা ডাকপিয়নের চিঠির থলে এখন তিরোহিত, উন্নয়ন ঘটেছে অভূতপূর্ব। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পৌঁছে যাচ্ছে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চিঠি-পত্র। ই-মেইল, ফ্যাক্স, মোবাইল ব্যাংকিং এখন গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষের নাগালে। ৩৬ হাজার কেজি ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বিশে^র ৫৭টির একটি। যার মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ, মোবাইল নেটওয়ার্ক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-বৃষ্টি জলোচ্ছ্বাস সম্পর্কে তথ্য দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে। এক সময়কার হাতুড়ে চিকিৎসার এই দেশে, বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত। পুষ্টি-প্রোটিন এবং হাতের কাছে চিকিৎসা সেবা থাকায় মাতৃমুত্যু প্রায় শূন্যের কোঠায়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন, উপজেলা পর্যায়ে অগ্নিনির্বাপক উপকরণ থাকায় বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণের দর্শন প্রতিফলিত হচ্ছে। বাসস্থানের উন্নয়নে হতদরিদ্রদের জন্য একটি বাড়ি একটি খামার, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, উপবৃত্তি, মাতৃকালীন ভাতার সবকিছুই আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুরই দর্শন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মহান নেতা আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ দর্শনে বিশ^াসী। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জলাশয় ভরাট, নদী-নালা খাল-বিল দখলমুক্ত কঠোর হওয়ার দিক-নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দর্শনেরই প্রতিফলন। ভারত-বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের সীমান্ত জটিলতা নিরসনে তিনিই ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি করে গিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে যে চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়ায় উভয় দেশের ৫৫ হাজার মানুষ সভ্য পৃথিবীর আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আধুনিক দর্শন এতই গভীর যে, বিশ^ গণমাধ্যমের চোখে তিনি ছিলেন এক ঐতিহাসিক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ^কে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর স্থান নির্ধারণ করেছেন সর্বোচ্চ আসনে। তিনি বাঙালি জাতির স্বপ্নপূরণ করেছেন। তাদেরকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন।’ প্রয়াত ভারত বিজ্ঞানী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু ঐশ^রিক আগুন এবং তিনি নিজেই সে আগুনে ডানাযুক্ত করতে পেরেছিলেন।’ ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জেএন দীক্ষিত বলেন, ‘প্রথম সরকার, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশে বাংলাদেশের পৃথক জাতিসত্ত্বায় গভীর বিশ^াসী ছিলেন। শেখ মুজিব এই উপমহাদেশে স্বতন্ত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয়ে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান এই উপমহাদেশের গণতন্ত্রের এক প্রতিমূর্তি, এক বিশাল ব্যক্তিত্ব।’ ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাবেক (বেলুচিস্তান) অফিসার মেজর জেনারেল তোজাম্মেল হোসেন মালিক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘মুজিব দেশদ্রোহী ছিলেন না। নিজ জনগণের জন্য তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক।’ তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার মুখপাত্র মেজর সিদ্দিক মালিক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে, তার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ঘরমুখী মানুষের ঢল নামে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল আশাব্যঞ্জক বাণী শ্রবণ শেষে মসজিদ অথবা গির্জা থেকে তারা বেরিয়ে আসছেন।’ তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নিয়ে নতুন করে বাড়াবাড়ি করলে তার প্রতিক্রিয়া অনিবার্যভাবে পাকিস্তানি সীমান্তের বাইরে ছড়িয়ে পড়বে।’ সেনেগালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদু দি উক ১৯৯৯ সালে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি এমন পরিবার থেকে এসেছেন, যে পরিবার বাংলাদেশকে অন্যতম মহান ও শ্রদ্ধাভাজন নেতা উপহার দিয়েছে। আপনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের জনগণ যথার্থই বাংলাদেশের মুক্তিদাতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।’
ড. পীযুষ কান্তি বড়ুয়া, তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের সমন্বিত রূপ। এর মধ্যে অর্থনীতির আওতায় কৃষি, শিল্প, আমদানি-রফতানি। মানবিক উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া ও মানবসম্পদ।’ বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই দর্শন সুস্পষ্ট, যেখানে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুস্থ-সবল জ্ঞান চেতনায় সমৃদ্ধ কোনোরকম ভেদ-বৈষম্য-শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক একটি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফাই বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের উর্বর বীজতলা। ১৯৭১ সালে আমেরিকান মিশনারি জেনিন লকারবি (চট্টগ্রাম) তার অন-ডিউটি ইন বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, ‘এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যে অনগ্রসর বাঙালি জাতিকে মুক্তির আস্বাদ দেবে, তাঁর নাম শেখ মুজিব।’ ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডসের সদস্য ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শীর্ষস্থানীয় যোদ্ধা ফেনার ব্রকওয়ে বলেছেন, ‘সংগ্রামের ইতিহাসে লেলিন, বোজালিবার্গ, গান্ধী, নকুমা, লমুমবা, ক্যাস্ত্রো ও আলেন্দার সঙ্গে মুজিবের নাম উচ্চারিত হবে। তিনি বলেন, ‘তাঁকে হত্যা করা ছিল, মানবতা হত্যার চেয়ে অনেক বড় অপরাধ। শেখ মুজিব শুধু তাঁর জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেননি, তিনি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন।’
ষ শিক্ষক ও নাট্যকার