ই-পেপার শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কোটিপতি টেলিফোন অপারেটর
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১০:৪৭ পিএম আপডেট: ২৮.০৯.২০২০ ১১:২২ পিএম  (ভিজিট : ৬৯৬)
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেলিফোন অপারেটর আবুল খায়ের। কর্মচারী হলেও বিলাসী জীবন তার। রয়েছে বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদ। হাসপাতাল অভ্যন্তরে স্ত্রীর নামে রোগীদের খাবার সরবরাহের ঠিকাদারি, দালাল-সিন্ডিকেট তৈরি, ভুয়া জখমি সনদ বিক্রি, ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে কমিশন আদায়, কর্মচারী ও নার্সদের বদলি, অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে তাকে অন্যত্র বদলিসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও রহস্যজনক কারণে তা দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন হয়নি। হাসপাতালের পাশের গ্রামেই বাড়ি হওয়ায় তার দাপটের কারণে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ডাক্তাররা মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যান বরাবর এক কর্মচারীর করা লিখিত অভিযোগ ও হাসপাতাল সূত্র থেকে জানা গেছে, ১৯৯২ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি চালু করা হয়। শুরুতে হাসপাতালের কর্মকর্তা, ডাক্তার, রেজিস্ট্রার, অপারেশন থিয়েটার ও ১৩টি ওয়ার্ডে স্টাফ নার্সদের জন্য মোট ৭০টি টেলিফোনে সেট ছিল। অভিযোগ রয়েছে, পরবর্তী সময়ে পাঁচ-ছয়টি সেট নষ্ট দেখানো হয় এবং বাকি সেটগুলো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মেশিন ও পিএ সেটসহ তিনি বিক্রি করে দেন। আবুল খায়ের নিরা টেলিকম নামে হাসপাতালের সামনে লাল মিয়া ম্যানসনে একটি টেলিফোনের দোকান পরিচালনা করেন। এ ছাড়াও হাসপাতালের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ১০টি হাইপাওয়ার ফুলচার্জ লাইট তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মেশিন, পিএ সেট টেলিফোনসহ স্থাপন ব্যয় প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. স্বপন কুমার অধিকারী এসব বিষয়ে আবুল খায়েরকে ২০১৯ সালের ১৯ মে ও ৭ আগস্ট দুদফায় কারণ দর্শানোর পত্র দিয়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, পিএ সেট ও টেলিফোন সেট কোথায় আছে এবং তা হাসপাতালে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বললেও তিনি এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো উত্তর দেননি। পরে বিষয়টি গড়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতর পর্যন্ত। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আবুল খায়েরকে বদলিসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে এখনও সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কর্মচারী হয়েও আবুল খায়ের ২০০১ সাল থেকে হাসপাতালের অভ্যন্তরে তার স্ত্রী জেসমিন আক্তারের নামে কাপড় ধোলাই ও পথ্য সরবরাহের ঠিকাদারি কাজ করে আসছেন। হাসপাতালে স্ত্রীর ঠিকাদারির নামে রোগীদের যথাযথভাবে খাবার সরবরাহ না করে স্থানীয় দাপটের কারণে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে আসছেন। হাসপাতালের ঠিকাদারি কার্যাদেশ ও তার স্ত্রীর নামে জমা দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স জব্দ করে এরই মধ্যে তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক টিম ও গোয়েন্দা সংস্থা।
হাসপাতালের একাধিক সূত্র ও লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, আবুল খায়ের কতিপয় নার্স, আউটসোর্সিং ক্লিনার ও স্থানীয় দালালদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী পাঠানো, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট লোকজনের চাহিদামতো করে দেওয়ার কথা বলে এবং হাসপাতাল থেকে ভুয়া জখমি সনদ বের করার বিনিময়ে অবৈধ অর্থ আয় করছেন তিনি। ২০১২-১৩ সালে এই হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক ডা. জিয়াউর রহমানের প্রধান সহযোগী হিসেবে ভুয়া জখমি সনদ বাণিজ্য করে বিপুল টাকা কামান তিনি। সে সময় বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডা. জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও, চোখের অন্তরালে থেকে যান আসল নায়ক খায়ের।
এ ছাড়াও হাসপাতালের অভ্যন্তরে তার নিজস্ব লোকদের নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান পরিচালনার এবং প্রধান গেটের পাশে দোকান বসিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ চাঁদা আদায় করেন আবুল খায়ের। সাধারণ কর্মচারী হয়েও বিলাসী জীবনযাপন করেন তিনি। তার নামে-বেনামে রয়েছে চারটি গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স। কুচাইতলি এলাকায় তিনি অবৈধ টাকায় তৈরি করেছেন দুটি বাড়ি। তার নামে-বেনামে থাকা বেশ কিছু সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু তার নামে থাকা চারটি স্থানে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও কুমিল্লা শহরের গোয়ালপট্টি এলাকায় তার দুটি দোকান রয়েছে বলে জানা গেছে।
শুধু অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনেই আবুল খায়ের দক্ষ নন, হাসপাতালের কাগজপত্র জালিয়াতি করে ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর সিলেকশন গ্রেড গ্রহণ করে প্রায় ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভোগ করেছেন। হাসপাতালের কর্মচারী ও নার্সদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে তিনি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগকারী বিল্লাল হোসেনের তথ্য মতে, সেলিনা আক্তারকে ওটি ইনচার্জ করে দেওয়া এবং তাকে দিয়ে ওটির ওষুধ কেনাকাটা করানো হবে বলে মিথ্যা আশ^াস দিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন আবুল খায়ের। তাকে ৩ লাখ টাকা দেওয়া হলেও বেশি টাকা পেয়ে ওটি ইনচার্জ করা হয় অন্যজনকে। সিনিয়র স্টাফ নার্স সুলতানা পারভীন, শিরীন আক্তার ও ফাতেমা আক্তারকে সুবিধাজনক স্থানে বদলির কথা বলে ১৫ লাখ টাকা আবুল খায়েকে দেওয়া হয়। কাজ না হলেও এখনও তিনি টাকা ফেরত দেননি।
হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নার্সরা জানান, দিনের পর দিন আবুল খায়ের হাসপাতাল অভ্যন্তরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জনসহ দালাল সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে হাসপাতালের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত করলেও তার দাপটের কারণে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। তাই তারা অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে আনা এসব বিষয়ে তদন্ত করে বিভাগীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াসহ অন্যত্র বদলির দাবি করেছেন। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত আবুল খায়েরের মোবাইলে রিং দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
তবে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুজিবুর রহমান মোবাইল ফোনে সময়ের আলোকে জানান, আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। তবে তার বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন স্বাস্থ্য অধিদফতরে জমা আছে। তিনি এ বছরের জানুয়ারিতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) যোগদান করেছেন। এ কারণে তেমন কিছুই তিনি জানেন না। তবে তার বিরুদ্ধে দেওয়া কিছু অভিযোগের ব্যাপারে কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হাজী আ. ক. ম বাহাউদ্দীন বাহার অবগত আছেন। তিনি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে তিনি জানেন।
এ ব্যাপারে সময়ের আলোর পক্ষ থেকে হাজী আ. ক. ম বাহাউদ্দীন বাহারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।















সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close