ই-পেপার শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

জেলেরা বাধা মানছেই না
প্রকাশ: সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২০, ১০:৫৬ পিএম আপডেট: ২৫.১০.২০২০ ১১:২৫ পিএম  (ভিজিট : ২০২)
মাত্র ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এরই মধ্যে চলেও গেছে বেশ কয়েকটি দিন। আর কয়েকদিন পরই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তবু যেন তর সইছে না একশ্রেণির লোভী জেলের। অভাব-অনটনের দোহাই দিয়ে অবৈধভাবে নির্বিচারে তারা শিকার করছে সম্ভাবনাময় মা ইলিশ। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অনুসারে মা ইলিশ সংরক্ষণে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়তই হামলার শিকার হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। রোববারও চাঁদপুর এলাকায় ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চালাতে গিয়ে নৌ পুলিশের অন্তত ২০ সদস্য আহত হয়েছেন। চারদিক থেকে ঘেরাও করে জেলেরা এ আক্রমণ চালায়। স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার ইলিশ সংরক্ষণে আরও কিছুটা কড়াকড়ি ভূমিকা পালন করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা। তারপরও থেকে নেমে নেই মা ইলিশ শিকার। কোথাও কোথাও স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল ও বরগুনাসহ ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোতে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে জেলেরা।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) কাজী শামস আফরোজ সময়ের আলোকে বলেন, এবার ইলিশ শিকারের নিষেধাজ্ঞার একদম শুরুতেই তথা গত ১৪ অক্টোবর থেকেই জেলেদের নির্ধারিত পরিমাণে চাল দেওয়া হয়। তা ছাড়াও মাত্র ২২ দিনের এ সময়ে না খেয়ে আছে এরকম কেউ নেই। এটা মূলত অভ্যাসগত কারণেই মাছের লোভে জেলেরা নদীতে নামছে। এবার নদীতে মাছের আনাগোনাও বেশি। অনেক সময় জেলেদের আটক করা হলে তারা বলে থাকে, ‘মাছ দেখলে নদী আমাদের ডাকে।’ মৎস্য অধিদফতরের ডিজি আরও বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে এখন পর্যন্ত শুধু চাল দেওয়া হয়। তবে আরও বেশি কিছু দিয়ে জেলেদের সহযোগিতা করা যায় কি না সে বিষয়েও চিন্তা করা হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জের পদ্মার বিভিন্ন পয়েন্টে বা চর এলাকা ঘিরে দেদারসে মা ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জের খাসকান্দি, বকচর, মোল্লারচর, বাঘাড়া খেয়াঘাট ও চাঁদপুরের লক্ষ্মীরচরসহ এমন অসংখ্য পয়েন্টে সুযোগসন্ধানী জেলেরা মাছ শিকারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মোল্লারচরে বসবাসরত বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন ছোট নৌকা নিয়ে মাঝ নদী থেকে সস্তামূল্যে বড় বড় মা ইলিশ কিনে কিনারায় নিয়ে হাতে হাতে সেগুলো বিক্রি করছে। রাতের বেলায় নৌকায় ইলিশ শিকার করা হচ্ছে অনেকটা উৎসবের মতো করে। নদীর পাড়ে বা বিভিন্ন পয়েন্টে পাহারা বসিয়ে মোবাইল ফোনের যোগাযোগ ঠিক রেখে নদীতে নামছে জেলেরা। যখনই পুলিশ বা প্রশাসনের লোকজন অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই পাহারাদাররা ফোন করে জেলেদের সতর্ক করে দিচ্ছে। এছাড়া মাঝ নদীতেই নৌকা-ট্রলার থেকে চলছে ইলিশ কেনাবেচা। সেসব ইলিশ রাতের আঁধারেই নৌকাযোগে চলে আসছে ঢাকায়। রাজধানীর বিভিন্ন হিমাগারে রাখা হচ্ছে মা ইলিশ। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেই চড়ামূল্যে বিক্রি করা হবে সেসব বড় আকারের মা ইলিশ। এছাড়াও মুন্সীগঞ্জে স্থলপথে ইলিশ পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে অভিনব নানা কৌশল। সম্প্রতি লাগেজে করে ইলিশ পাচারের সময় সেটিও ধরা পড়ে। এর বাইরেও বালতি, ব্যাগ-বস্তা, গাড়ির সিটের নিচেসহ সন্দেহ এড়ানোর মতো নানা জায়গায় করে ইলিশ পাচার করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান সময়ের আলোকে বলেন, সরকার এ বছর চাঁদপুরের ৫১ সহস্রাধিক জেলের মধ্যে ৫০ হাজার জেলেকে ২০ কেজি করে চাল দিচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। সরকারও খাদ্য সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আন্তরিক। সীমাবদ্ধতা থাকবেই, এরপরও দেশের সম্পদ রক্ষায় সবাইকে সরকারি নিয়ম মানতে হবে। অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নদীর পাশাপাশি আশপাশের খাল-বিলে এখন অনেক পানি। অভিযানে নামলেই ওইসব অসাধু জেলে খাল-বিলে ঢুকে পড়ে। এছাড়াও দ্রুতগতির যান ও নৌপুলিশের জনবল সঙ্কটের কারণে আমরা তাদের নিবৃত্ত করতে পারছি না। তবে এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা আরও বেশি আন্তরিক হলে এদের আরও নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। 
ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষায় দেশের উপকূলীয় পদ্মা-মেঘনা ও সাগর মোহনার ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় চলছে ইলিশ প্রজনন মৌসুম। সে হিসাবে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকায় প্রজনন মৌসুমের (১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত) ২২ দিন ইলিশ মাছ আহরণ, বিপণন, মজুদ, ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে সরকার। অথচ সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জেলেরা। তারা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সুযোগ পেলেই দলবদ্ধ হয়ে নেমে পড়ছে নদীতে। আর অবাধে শিকার করছে ডিমঅলা মা ইলিশ। এতে করে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের ইলিশ সম্পদ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, এই মৌসুমে ইলিশ ধরা অবশ্যই ক্ষতিকর। কারণ ইলিশের বংশবিস্তারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতেই এই নিষেধাজ্ঞা। এরপরও যেকোনো কৌশলেই হোক অসাধু জেলেদের সচেতন করতে হবে। অন্যথায় আগামী দিনে হুমকিতে পড়বে ইলিশ সম্পদ। অসাধু মাছ ব্যবসায়ীরা নদীতে মাছ শিকার করে নদীতীরে এসে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩শ’ টাকা দরে বিক্রি করে আবার চলে যাচ্ছে নদীতে। আর ক্রেতা কেউ লাগেজে, কেউ পলিথিন ব্যাগে, কেউ পাতিলে করে নানা কৌশলে গ্রামের ভেতর দিয়ে নিয়ে আসে শহরে। নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর এ পর্যন্ত মাওয়া নৌপুলিশের অভিযানে ১৫ জনকে আটক ও আধা মণ ইলিশ জব্দ ও ১ লাখ ৫ হাজার মিটার কারেন্ট জাল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ সময় একটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে।
চাঁদপুরে নৌপুলিশের ওপর জেলেদের সংঘবদ্ধ হামলা : রোববার সকালে চাঁদপুরে মা ইলিশ রক্ষা অভিযানে জেলেদের হামলায় নৌপুলিশের অন্তত ২০ সদস্য আহত হন। ঢাকার নৌ হেডকোয়ার্টার থেকে একটি লঞ্চ ও পাঁচটি স্পিডবোটে নৌপুলিশের দলটি চাঁদপুর নৌ সীমানার পদ্মা-মেঘনায় মা ইলিশ রক্ষায় এ অভিযানে নামে। চাঁদপুর সদর উপজেলার রাজরাজেশ^র ইউনিয়নের লক্ষ্মীরচর এলাকায় মেঘনা নদীতে অভিযানে গেলে জেলেরা চারদিক থেকে ঘেরাও করে নৌপুলিশের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় জেলেদের নিক্ষিপ্ত ইটপাটকেলে নৌপুলিশের সদস্যরা গুরুতর আহত হন। বর্তমানে আহতরা চাঁদপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তারা হলেনÑ নৌপুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ফরিদা পারভীন, নৌপুলিশ সদস্য এসআই ইলিয়াস, প্রসেনজিৎ, হেলালউদ্দিন, নায়েক ইকবাল, মুজাহিদুল ইসলাম, আল মামুন, ফেরদৌস শেখ, নীলয় দেব, আলামিন, কাউসার, মোনায়েম ও নায়েক শাহজালাল। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন নৌপুলিশ সদস্য সামান্য আহত হলে তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
হামলার শিকার নৌপুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ফরিদা পারভীন বলেন, হামলা থেকে রক্ষা পেতে নৌপুলিশ শটগান ব্যবহার করে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। লক্ষ্মীরচর এলাকায় মেঘনা নদীতে অভিযানকালে জেলেরা তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় জেলেদের নিক্ষিপ্ত ইটপাটকেলে নৌপুলিশ সদস্যরা আহত হন। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান আরও জোরদার করা হবে বলেও জানান তিনি। রোববার ভোররাত থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার আকাশপথে এবং নৌপথে নৌপুলিশ চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদীর বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার অভিযান শেষে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ঢাকায় ফিরে গেলেও নদীতে অভিযান অব্যাহত রাখে নৌপুলিশ। বেলা ১১টার দিকে সদর উপজেলার রাজরাজেশ^র ইউনিয়নের লক্ষ্মীরচরের একটি খালে বেশ কয়েকজন জেলে নৌকা দেখে সেখানে নৌপুলিশের বহরটি অভিযান চালাতে যায়। এ সময় সংঘবদ্ধ জেলে ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নৌপুলিশের ওপর হামলা করে। এতে অন্তত ২০ পুলিশ আহত হন। চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুজাউদৌলা রুবেল জানান, আহতদের বেশিরভাগেই মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়েছে। তবে সবাই অনেকটা আশঙ্কামুক্ত।
নাটোরে বিপুল জাটকা ও কারেন্ট জাল জব্দ : নাটোর সদর উপজেলার তেবাড়িয়া হাট থেকে রোববার দুপুরে ৭০ কেজি জাটকা ও ১০ হাজার মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল জব্দ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই সঙ্গে জাটকা বিক্রি করার দায়ে মো. রুস্তম আলী নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অভিযান পরিচালনা করেন নাটোর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ শাওন। তিনি জানান, প্রজনন মৌসুমে ইলিশের বিপণন, পরিবহন, বেচাকেনা ও মজুদ বন্ধে দুপুরে তেবাড়িয়া হাটে ওই অভিযান চালানো হয়।
এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সময়ের আলোর চাঁদপুর প্রতিনিধি শরীফুল ইসলাম ও মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জুয়েল রানা।






সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close