তুরস্ক ফ্রান্সের মুসলিমবিদ্বেষী আচরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন পর্যন্ত জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে তুরস্ক। ইসলামের নবীকে অবমাননায় সমর্থন করায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে মানসিক চিকিৎসা করানো দরকার বলে পরামর্শ দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। একইসঙ্গে এরদোগান তার দেশের জনগণকে ফরাসি পণ্য বর্জনেরও আহŸান জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ইসলামবিরোধী ইস্যুতে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে থামানোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের আহŸান জানিয়েছেন ন্যাটো জোটের মিত্র দেশটির এই মহান নেতা।
পাকিস্তান
এরদোগানের পর কোনো রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে জোরালো প্রতিবাদ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ফ্রান্সকে এক হাত নিয়ে ইমরান খান নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ পরিষ্কারভাবে কিছু না জেনেই ইসলাম ও আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) উদ্দেশ করে ধর্ম অবমাননা কার্টুন প্রদর্শনে উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে ইউরোপ ও বিশ^জুড়ে লাখ লাখ মুসলমানের অনুভ‚তিতে আঘাত করছেন এবং মুসলিমদের উসকে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন।’ এ প্রেক্ষিতে ইসলামভীতি ছড়ানোর বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহŸান জানিয়েছেন ইমরান খান। এ জন্য তিনি মুসলিম বিশে^র নেতাদের কাছে একটি চিঠিও লিখেছেন। এ ছাড়াও ইসলাম ও ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) অবমাননার এই ঘটনায় পাকিস্তানে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সৌদি আরব
একটু দেরিতে হলেও এ বিষয়ে ফ্রান্সের সমালোচনা করেছে সৌদি আরব। দেশটির নাম উল্লেখ না করে সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মহানবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) নিয়ে আপত্তিজনক কার্টুন প্রকাশ কিংবা সন্ত্রাসের সঙ্গে ইসলামকে জড়ানোর যেকোনো উদ্যোগের নিন্দা জানাচ্ছে রিয়াদ। বিবৃতিটি দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তা ছাড়া দেশটির নামিদামি কয়েকজন ব্যবসায়ী ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের আহŸান জানিয়েছেন।
ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে দেশটির জনগণ। গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন দল হামাসের তত্ত¡াবধানে গাজার রাফাহ অঞ্চলে মানববন্ধন ও মিছিল করেছে তারা। প্রতিবাদ মিছিলে হামাসের কর্মকর্তা জুময়াহ গুল বলেন, ইসলাম ধর্ম ও মহানবীকে (সা.) নিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য ও ফরাসি পত্রিকা শার্লি হেবদোতে প্রকাশিত ব্যঙ্গচিত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। নিজ বক্তব্য প্রত্যাহার করে মুসলিম উম্মাহর নিকট ম্যাক্রোঁর ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত বলে হামাস নেতা মনে করেন।
লিবিয়া ও লেবানন
লিবিয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এক বিবৃতিতে অবিলম্বে ম্যাক্রোঁকে বিশ^ মুসলিমের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহŸান জানিয়েছে। লেবানন সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানা গেলেও দেশটির দারুল ইফতার মহাসচিব আমিন কুরদি এক বিবৃতিতে জানান, ‘মহানবী মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর কট‚ক্তি মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াবে। স্বাধীনতার নামে মহানবী মোহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননা জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ ও ধর্মীয় সংঘাত তৈরি করবে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।’
কুয়েত ও কাতার
ফ্রান্সে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে কুয়েতেও। ফ্রান্সের এ ধরনের ধৃষ্টতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে দেশটির ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি। সংস্থাটির প্রধান মারজুক আল গানেম ক‚টনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিশ^বাসীকে ইসলামসহ বিশে^র সব ধর্ম ও বিশ^াসের অবমাননা বন্ধে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ কাতারেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৫-২৯ অক্টোবর থেকে ফ্রান্স-কাতার সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে কাতার বিশ^বিদ্যালয়।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রতিবাদ বা নিন্দা না জানানো হলেও ফ্রান্সের এমন কর্মকাÐের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে এখানকার মুসলিম জনগণ। ইসলামভিত্তিক একটি সংগঠন ফ্রান্সের দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও দিয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের হ্যাকার কমিউনিটি ‘সাইবার ৭১’ ইতোমধ্যে ফ্রান্সের কয়েকটি রাষ্ট্রীয়, বাণিজ্যিক ও পত্রিকার ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। তাদের হ্যাকের কথা স্বীকার করেছে ফ্রান্সের যথাযথ কর্তৃপক্ষ। সেসব ওয়েবসাইটে বর্তমানে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নামই কেবল প্রদর্শিত হচ্ছে।
ফরাসি পণ্য বর্জন
বিক্ষোভ, মিছিল ও নিন্দা প্রকাশের প্রতিবাদ ছাপিয়ে ফ্রান্সকে সব থেকে বেশি বিব্রতকর পরিস্থির সম্মুখীন করেছে মুসলিম দেশগুলোর ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক। উপরোল্লেখিত দেশগুলো ছাড়াও জর্দান, মরক্কো, আলজেরিয়া, ইরাক, মৌরিতানিয়া, ইয়েমেন, ইরান প্রভৃতি দেশে এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ফরাসি পণ্য বর্জনের আহŸান জানানো হয়েছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে গলার স্বর নরম হয়ে এসেছে ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর। তাদের পণ্য বর্জন না করতে বিভিন্ন দেশের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতিবাদ
বিশ^ মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম ‘ওআইসি’ ফ্রান্সের প্রতি নিন্দা জানিয়ে বলেছে, মুসলিমদের অনুভ‚তিতে আঘাত করে ফ্রান্স কর্তৃক ধর্মীয় প্রতীকের ধারাবাহিক অবমাননার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে ওআইসি। একইসঙ্গে এই ঘটনায় সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ ‘হাইয়াতু কিবারিল উলামায়িস সাউদিয়া’ও ফ্রান্সের সমালোচনা করেছে। পরিষদের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ বলেন, নবীকে অবমাননা করা মানে সন্ত্রাসীদের সাহায্য করা। বিশে^র জ্ঞানী-গুণীদের এরূপ অবমাননার নিন্দা জানানো উচিত। মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম সব নবী-রাসুলের অসম্মান ও অবমাননাকর সব কাজ থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দেয়।
মিসরের আল আজহার বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ইমাম আহমদ তাইয়েব বলেন, একজন মুসলিম ও আল আজহারের প্রধান হিসেবে আমি ঘোষণা করছি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ফ্রান্সে ধর্ম অবমাননা ও ধর্মীয় নিদর্শনাবলি নিয়ে কট‚ক্তি দ্বিমুখী নীতি এবং প্রকাশ্যে বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রচারের শামিল।’ বিশ^বরেণ্য ইসলামিক স্কলার মুফতি তাকি উসমানি ফরাসি পণ্য বর্জনের মাধ্যমে সবাইকে প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহŸান জানিয়েছেন। একই আহŸান জানিয়েছেন আরব বিশে^র প্রখ্যাত আলেম ইউসুফ কারযাভী ও পাকিস্তানের প্রখ্যাত দাঈ মাওলানা তারিক জামিল। আরব বিশে^র আরেক প্রথিতযশা আলেম বিশিষ্ট হাদিসবেত্তা শায়খ শরিফ হাতেমও নবী অবমাননায় ফ্রান্সের নিন্দা করেছেন।
তা ছাড়া ইসরাইলসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের অনেক নিরপেক্ষ অমুসলিমও ফ্রান্সের এই হঠকারিতার বিরোধিতা করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইমান আর রাহমানী নামের কসোভার এক এমপি এবং কুয়েতের আল কাদিসিয়া নামের একটি ফুটবল দল।
দলটির খেলোয়াড়েরা ম্যাচ শুরুর আগে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে একটি ব্যানার হাতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। ওই ব্যানারে লেখা ছিলÑ ‘আমার মা-বাবা আপনার প্রতি উৎসর্গিত হোক প্রিয় রাসুল (সা.)।’ আর কসোভার এমপি ‘আমি মোহাম্মদকে ভালোবাসি’ লেখা মাস্ক পরে সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে মহানবী (সা.)-এর অবমাননার অভিনব প্রতিবাদ করেন।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, আনাদুলু, ইয়েনি শাফাক, টুইটার