করোনাভাইরাস গোটা মানবজাতির জন্য এখন একটা প্রাণঘাতী আতঙ্কের নাম। বিশে^র উন্নত দেশসমূহ এই ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ দুনিয়ার অগ্রসর রাষ্ট্রগুলো করোনাভাইরাসের আঘাতে বিপর্যস্ত। প্রথম বিশ^, দ্বিতীয় বিশ^,
তৃতীয় বিশ^। সব এখন আক্রান্ত ও ধ্বংসের বিপদের মুখে। সংক্রমণের গতি থেমে নেই। আক্রান্তদের দেহ ও মনের কষ্টসহ চিকিৎসাসেবার অসহায়ত্ব, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবজ্ঞা ও অবহেলায় পরিস্থিতি যারপরনাই জটিল। এমনিতেই বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে একদিকে গরিব রোগাক্রান্ত মানুষের উপচে পড়া ভিড়। অন্যদিকে অত্যন্ত দুর্বল পরিকাঠামোর জন্য বিনা চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যু প্রকৃত বাস্তবতা। এই পরিস্থিতিতে দুরন্ত কালবৈশাখী ঝড়ের মতো করোনাভাইরাস আক্রমণে স্বাস্থ্য পরিসেবা যেন দিশেহারা হয়ে যায়।
যদি না হয় সামাজিকীকরণ, মাছির মতো মানুষের মরণ
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় প্রাদুর্ভাব ঘটে স্প্যানিশ ফ্লুর। বিশে^ প্রায় ৫০ কোটি মানুষ ওই ফ্লুতে মারা যায়। ওই সংখ্যাটি ছিল সে সময় বিশে^র মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ব্রিটিশ উপনিবেশের শাসনাধীনে ১৫০ বছর পার করা প্রাচীন বাংলায় ১ দশমিক ৮০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয় ওই ভয়ঙ্কর মারণ রোগের ছোবলে। সে সময়ে ব্রিটিশ শাসক-শোষকরা স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরির জন্য মাথা ঘামাত না। মানুষের মরণ হয়েছে মশা-মাছির মতো বিনা চিকিৎসায়। অবশ্য রাজা, মহারাজা, জমিদার ও উচ্চবিত্ত ব্রিটিশের পদলেহনকারীদের কথা ছিল আলাদা। তারা গোলামীর আর্থিক সুবিধার ছিটেফোঁটায় প্রাণে বেঁচে যায়। জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আবশ্যকতা প্রথম আমাদের দেশে টের পাওয়া যায় সেই ভয়ঙ্কর ব্রিটিশ শোষণের সময়।
করোনাভাইরাস দেখিয়ে দেয় সামাজিকীকরণ কেন প্রয়োজন?
কথায় বলে, সঙ্কট জন্ম দেয় সম্ভাবনা ও সৃজনের। মানুষ সামাজিক জীব। সংঘবদ্ধভাবেই বসবাস করা মানুষের আদিম স্বভাব। মহামারি বিপদে মানুষ পথ খোঁজে সমাজবদ্ধ কাঠামোর ভেতরে। খোলাবাজার পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত-শ্রমজীবী মানুষ গণআন্দোলনের বৃত্তে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর দেখা যায়, পৃথিবীর দেশে দেশে পুঁজিবাদ পিছু হটে। ইতিহাস আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যায় গণবণ্টন ব্যবস্থা। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষার মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিরিখে চীনের মতো দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দায়বদ্ধ সরকার। এবার করোনাভাইরাস মহামারির অধ্যায়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই যেন চোখে পড়ে। এই ভয়ঙ্কর সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় দেশে দেশে দুর্বল ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিসেবার শুদ্ধিকরণ ও সামাজিকীকরণের এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মূলপথ থেকে সরে এসে জনস্বাস্থ্যসেবার উপযোগী উপকরণ, যন্ত্র ও সরঞ্জাম, হাসপাতাল ইত্যাদি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নির্মাণ শুরু হয়ে যায়। স্পেন, ইতালি, ফ্রান্সের মতো দেশেও বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়।
করোনাকালে পুঁজিবাদী
দেশে সমাজতন্ত্রের ছায়া
প্রথম বিশে^র উন্নত দেশগুলোতেও টেস্ট কিট ইত্যাদি মুষ্টিমেয় অতি ধনী ছাড়া আর কারও আয়ত্তে ছিল না। এই টেস্ট কিট উৎপাদনের জন্য তারা সামরিক আইনের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত বেসরকারি ও বহুজাতিক উৎপাদন সংস্থাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও চিকিৎসকদের মাস্ক, পোশাক, ওষুধ এবং অন্যান্য সহযোগী দ্রব্য উৎপাদনের জন্য কড়া সামরিক আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হন।
আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যের জন্য ২ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ মঞ্জুর করে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা। ওইসব দেশেও বেসরকারি হাসপাতালের রমরমা ব্যবস্থা স্বাস্থ্য পরিসেবায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার ধারণাটাকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়। রাষ্ট্র এবং তার নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে দেশের পরিচালনার প্রত্যেক স্তরে। যা পুঁজিবাদী মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম প্রতীক। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা ও ল্যাটিন আমেরিকার কিছু সমাজতান্ত্রিক দেশের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো বিষয়ক রাষ্ট্রের যে নীতি ও আইন রয়েছে, তারই ছায়া যেন করোনাকালে প্রথম বিশে^র পুঁজিবাদী দেশগুলোতে চোখে পড়ে।
করোনায় বিজ্ঞানবিরোধী
রাষ্ট্রব্যবস্থার অসারতা
সামাজিকীকরণের পক্ষে মানুষের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম উপাদানের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য পরিসেবা এবং জীবিকার নিশ্চয়তার পাশাপাশি অন্ন, বস্ত্র ও শিক্ষার অধিকার। করোনা মহামারি প্রমাণ করে দিল, তথাকথিত উন্নত ও শিল্পোন্নত বিশে^ স্বাস্থ্য পরিসেবা মুষ্টিমেয় কোটিপতি ও অতি ধনীদের জন্যই এতদিন সীমাবদ্ধ ছিল। মধ্যবিত্ত এবং সমাজের অন্য অনগ্রসর মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ছিল বীমানির্ভর নড়বড়ে ব্যবস্থা। যেখানে রাষ্ট্রের কোনো দায়দায়িত্ব ও ভূমিকা ছিল না। করোনাভাইরাসের ঝড় এই অমানবিক ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এই মহামারির আক্রমণ এবার প্রমাণ করল প্রথম বিশে^র বিজ্ঞানবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রগাঢ় অসারতা। অথচ বিজ্ঞানবোধই হলো সামাজিক জনজীবনের শক্ত ভিত্তি। করোনাভাইরাসজনিত এই সঙ্কট পুঁজিবাদী পথের অসারতাকেই প্রমাণ করেছে।
করোনায় বিজ্ঞানীদের
সতর্কতা নিয়ে উপহাস!
বিজ্ঞান উন্নত, স্বাস্থ্যকর, সামাজিক জীবনযাপনের কথা বলে। আর সামাজিক যাপন জন্ম দেয় গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা। এ কারণে পুঁজিবাদ জনমানসে ও মানুষের সামাজিক জীবনযাপনে বিজ্ঞানবোধের প্রসার পছন্দ করে না। এমনকি রাষ্ট্রের উৎপাদন নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তারা বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সম্মেলনে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানের বিবৃতি থেকেও অভিমুখটি খুব স্পষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞানীদের করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সতর্কতাকে উপহাস করা হয়েছে। অথচ অসুখ হলে তারাই কিন্তু বিজ্ঞানী চিকিৎসকের সাহায্য চেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে দ্বিধা করেন না। দেরিও করেন না। করোনাভাইরাস মার্কিন ও তার সহচর ইউরোপের দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়কদের বিজ্ঞানের হাত ধরতে এবার বাধ্য করে। করোনাভাইরাস মহামারির চিকিৎসার জন্য কোয়ারেন্টাইন বা ঘরবন্দি থাকার বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে সুবিস্তৃত করা, ভ্যাকসিন আবিষ্কারকে উৎসাহ দান, ওষুধ শিল্পকে এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করানো ইত্যাদি সামাজিক কাজে তাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে বিজ্ঞানের হাত ধরে। এখনও সবাই মিলে উপযুক্ত প্রযুক্তির খোঁজ করছে। যার সাহায্যে এই মহামারিকে প্রতিরোধ করার প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায়।
করোনায় চিকিৎসা
সামগ্রী নিয়ে জালিয়াতি
চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অন্যতম। আমাদের সংবিধানেও তা স্বীকৃত। চিকিৎসা নিয়ে হরহামেশা প্রতারণার শিকার হয় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। এখন জেলায় জেলায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বিল্ডিং হয়েছে। সবই দৃষ্টিনন্দন, সুন্দর ও নতুন। যা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় বৈকি! তবে এখনও ঠনঠনে বাসনের মতো ভেতরটা ফাঁকা ও ফাঁকিতে ভরা। করোনা না এলে মানুষ এটা বুঝতে পারত না।
আমাদের দেশের করোনার প্রথমদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোনো টেস্টিং ব্যবস্থাই ছিল না। ভ্যাকসিন হিরো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করেন। বলাই বাহুল্য, নানা রকম জোচ্চুরি জালিয়াতি, সাহেদ-সাবরিনার প্রতারণায় সেই ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এমনকি নিরাপত্তাহীন চিকিৎসা সামগ্রী দিয়ে করোনা চিকিৎসায় নিবেদিত করা হয় চিকিৎসকদের। যা শুধু বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয়ই নয় বরং দেশের আত্মসম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
করোনায় ভুয়া চিকিৎসা
প্রতিষ্ঠানের জোচ্চুরি
১৯৮২ সালের মেডিকেল অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই। অথচ দেশে গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক ও হাসপাতাল। বছরের পর বছর সরকারি অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। খবরে প্রকাশ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন এবং যথাযথ সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চিকিৎসার নামে প্রতারণায় জড়িত দেশের ১১ হাজার ৯৪০টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। রাজধানীতে সুদৃশ্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে চালানো হয় ভুয়া হারবাল ক্লিনিক। পাশাপাশি ফুটপাথে, ট্রেনে, বাসে, স্টিমারে, লঞ্চে, দেশের গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে চিকিৎসার নামে চলে প্রতারণা। প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে শত শত নিরীহ মানুষ। যেগুলোর পরিসংখ্যান নেই, নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ।
এ মুহূর্তে আবেগে আর হুজুগে না মেতে করোনা প্রতিরোধে টেকসই পন্থা অবলম্বন না করলে বৈশি^ক এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। আমাদের দেশে টেকসই আয়োজন হতে পারে নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, দায়িত্বশীল সৎ স্বাস্থ্যপ্রশাসন আর উপযুক্ত পরীক্ষাগার, গবেষণাগার ও গবেষক গড়ে তোলা। আত্মপ্রচার নয়, অনুভব করার প্রতিযোগিতা দরকার। মানবিকতার প্রদর্শন নয়, বিবেকের দংশন আর সময়োপযোগী মানবিক আচরণ এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
করোনাকালে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য কাঠামোকে ঢেলে সাজানো ও প্রশস্ত করার বাধ্যবাধকতা সূচিত করেছে। করোনা স্বাস্থ্যসেবার সামাজিকীকরণ শিখিয়েছে। রাষ্ট্রকে মৌলিক প্রশ্নের সুষ্ঠু সমাধান করতে হলে উৎপাদন ব্যবস্থা
এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় সমাজ-সংঘবদ্ধতা বা সমাজতান্ত্রিক পথ অনুসরণই একমাত্র বিকল্প।
ষ লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক