ই-পেপার শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

তাজরীনের আহত শ্রমিকদের আর্তনাদ
আমাদের বাঁচতে দিন নতুবা আত্মাহুতি দেব
প্রকাশ: বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০, ১১:১৮ পিএম আপডেট: ২৪.১১.২০২০ ১১:৫৬ পিএম  (ভিজিট : ১৫৬)
মোখতার হোসেন, বয়স ৫০ বছর। কাজ করতেন তাজরীন গার্মেন্টস কারখানার ৫ তলায় কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর পদে। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আগুন লাগার পর ৫ তলা থেকে লাফ দিলে কোমরে প্রচণ্ড আঘাত পান, বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে যায় এবং মাথায়ও আঘাত পান তিনি। দুর্ঘটনার পর থেকে গত আট বছর ধরে কোনো কাজ করতে পারেন না। তিনিসহ তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে আহত ৪৫ শ্রমিক পরিবার তিন দফা দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন করছেন টানা ৬৭ দিন ধরে। মঙ্গলবার মোখতার হোসেনের সঙ্গে কথা হয় প্রেসক্লাবের সামনে।
তিনি বলেন, ‘বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছে আমার। কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি আমরা। আমরা চিকিৎসা করাতে পারছি না, সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি না। বাধ্য হয়ে অনশনে নেমেছি। আমরা ৬৭ দিন ধরে রাস্তায় পড়ে আছি খেয়ে-না খেয়ে। আমাদের পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়নি। রাস্তায় পড়ে আছি, দাবি আদায় না হওয়া  পর্যন্ত এখানেই পড়ে থাকব। প্রয়োজনে আমরা সবাই মিলে আত্মহত্যা করব, সে প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি। তাজরীনে তো আমাদের মরণ হয়নি, সেই মরণ আমরা এখানে মরব।’
আরেক শ্রমিক মো. সোলাইমান, তাজরীনের সুইং সুপারভাইজার। কারখানাটির চতুর্থ তলায় কাজ করতেন। আগুন লাগলে চারতলা থেকেই লাফ দেন। নিচে পড়ে গিয়ে ডান পা ভেঙে আট কুচি হয়ে যায়। এ ছাড়া কোমরে ও পিঠে প্রচণ্ড আঘাত পান। ওই দিন তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সাভারের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, ওখানে ২৬ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। সেই থেকে আট বছর ধরেই আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়। ওষুধ না খেলে আমি সুস্থ থাকতে পারি না। কোনো কাজ করতে পারি না, খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। এই আট বছরে ১২-১৫ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে আমার। চিকিৎসার জন্য ভিটেমাটি বিক্রি করেছি, এখন অনেকটা উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে মহা সঙ্কটে আছি আমি। তাজরীন মালিক, বিজিএমইএ কিংবা সরকারÑ কোনো পক্ষ থেকেই আমরা একটি টাকাও সাহায্য বা অনুদান পাইনি। শুধু বিদেশি একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে ২ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিলাম, সেই শুরুর দিকে। প্রতি মাসে ৪-৫ হাজার টাকা করে আমার শুধু ওষুধ খরচ লাগে, কিন্তু টাকা জোগাড় করতে না পারায় চিকিৎসা করাতে পারছি না। খুবই কষ্টে আছি, মানবেতর জীবনযাপন করছি। এ জন্য আমরা ৪৫টি পরিবার তিনটি দাবি নিয়ে গত ৬৭ দিন ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টানা অনশন কর্মসূচি পালন করছি। দাবিগুলোর মধ্যে আছেÑ পুরো কর্মজীবনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদি সুচিকিৎসা। তাজরীন কারখানার মালিক, বিজিএমইএ এবং সরকারের কাছে আমরা এই ক্ষতিপূরণ চাই। আমার বাবা মারা গেছেন। মা, দুই বোন, ছোটভাই ও স্ত্রী-সন্তানসহ সাতজনের পরিবার আমার। পুরো পরিবার আমার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমি কোনো কাজ করতে পারছি না।
একই কারখানায় সুইং অপারেটর নাসিমা আক্তারও কাজ করতেন তাজরীন কারখানার চতুর্থ তলায়। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর কারখানায় আমি কর্মরত ছিলাম। আগুন লাগার পর আমি কোনো রকম তিন তলা পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়। তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়লে আমার দুই হাত ভেঙে যায়, মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়, মাথায় আঘাত পাই। আট বছরেও আমি সুস্থ হতে পারিনি। এরপর থেকে আমি চোখে ভালো মতে দেখতে পারি না। গত ৮ বছরে চিকিৎসার পেছনে আমার লাখ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। জায়গা-জমি বিক্রি করে আমি চিকিৎসা করেছি, কিন্তু এখন আর আমার চিকিৎসা করার মতো কোনো অর্থ নেই। তিন ছেলে-মেয়ে, অসুস্থ স্বামী (তিনিও তাজরীনের আহত শ্রমিক) নিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছি। মালিক, সরকার বা বিজিএমইএÑ কোনো পক্ষ থেকেই আমরা একটি টাকাও সাহায্য পাইনি। তাই আমরা এক জীবনের ক্ষতিপূরণ চাই। আমি যদি সুস্থ থাকতাম তা হলে প্রতি মাসে ১০-১২ হাজার টাকা করে বেতন পেতাম। এভাবে প্রতিবছর ১ লাখ টাকা হিসাবে ৪০ বছরের কর্মজীবন ধরে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমরা খেয়ে-না খেয়ে ৬৭ দিন ধরে প্রেসক্লাবের সামনে পড়ে আছি। আমার ছেলে এখানে এসেছিল, এসে বলেছিলÑ মা বাড়িতে খাবার পায় না, এখানে হয়তো ভালো খাবার পাওয়া যাবে, আম্মু হয়তো এখানে ভালো খাবার খায়। এখানে এসে দেখে আরও কষ্ট, তারচেয়ে বাসায় চলে যায়। পরে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমরা কারও কাছে ভিক্ষা চাই না, করুণা চাই না। আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা চাই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাই, এই আমরা অসহায়-আমাদের দিকে একটু তাকান, আমাদের জন্য কিছু একটা করেন।
অন্যদিকে তাজরীনের আহত শ্রমিকরা দাবি আদায়ের জন্য মঙ্গলবার প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি দিতে যান জীবন্ত লাশের মিছিলসহ। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে কদম ফোয়ারা মোড়ে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। পরে একটি প্রতিনিধিদল গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপির কপি পৌঁছে দিয়ে আসে। এ সময় শ্রমিকরা বলেন, ১১৪ জন শ্রমিককে আগুনে পুড়িয়ে মেরে তাজরীনের মালিক দেলোয়ার প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ পর্যন্ত তার কোনো বিচার হয়নি। আমরা চাই তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক এবং মালিকের কাছ থেকে যেন আমাদের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়া হয়।
৮ বছর ধরে ঝুলে আছে মামলা : দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ঝুলে আছে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের মামলা। রাষ্ট্রপক্ষ শুনানিতে সাক্ষী হাজির করতে পারছে না বলে মামলায় অগ্রগতি নেই। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেই ঘটনায় করা মামলায় কয়েকদিন পর পর নতুন করে শুধু শুনানির দিনই ধার্য হচ্ছে। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ছিল। বিচারক উপস্থিত না থাকায় আদালত বসেনি। অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিকদের অনেকে যারা ক্ষতিপূরণের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করছেন তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী শুনানির তারিখ আগামী বছরের ১৩ জানুয়ারি। তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেন জামিনে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, রাজধানীর অদূরে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান, পরে আহত আরও দুজন শ্রমিক মারা যান। এ ছাড়া অসংখ্য শ্রমিক গুরুতর আহত হন। ওই ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি মামলা হয়।
৮ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচি পালন : অন্যদিকে তাজরীন দুর্ঘটনার ৮ বছর পূরণ হলো মঙ্গলবার। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের উদ্যোগে মঙ্গলবার সকালে জুরাইন কবরস্থানে অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।
তা ছাড়া তাজরীন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডের আট বছর স্মরণে এলাকাভিত্তিক আলোচনা সভা, মোমবাতি প্রজ্জলন ও জুরাইন কবরস্থানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক সমন্বয় কমিটি ও ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি)। এ ছাড়া বিলসের সহযোগিতায় তাজরীন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডের আট বছর স্মরণে মঙ্গলবার সকালে জুরাইন কবরস্থানে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।









সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close