ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা সোমবার ২ অক্টোবর ২০২৩ ১৭ আশ্বিন ১৪৩০
ই-পেপার সোমবার ২ অক্টোবর ২০২৩

কবিতার বিজয়, কবিতায় স্বাধীনতা
কুশল ভৌমিক
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:১৯ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ  Count : 438

 শব্দ দিয়ে শব্দাতীত একটা জগৎ নির্মাণ করাই কবিদের কাজ। কবিতার তাই নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকতে নেই, কবিতা হয়ে ওঠার ব্যাপার। তবুও যুগে যুগে কবিতাই তুলে ধরে জীবন ও সমাজ, হয়ে ওঠে মানবিক বোধের প্রতিবিম্ব। হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ডানায় ভর করে বাঙালি জাতির যে অগ্রযাত্রা তা কিন্তু প্রতিটি বাঁকে এসেই বিনম্র স্বস্তি অনুভব করেছে কবিতার কাছেই। বাঙালি জাতির সভ্যতা বিনির্মাণের যে গৌরবময় পথ, আর সময়ে সময়ে নিয়তি, প্রকৃতি আর বহিঃশত্রæর সাথে সংগ্রামের যে বিপুল ইতিহাস তা কবিতায় যাপিত হয়েছে অতি সন্তর্পণে। কবিতা তাই আমাদের ইতিহাস চেতনা, সভ্যতা আর সংস্কৃতির অন্তরালের অনুভব। হাজার বছর আত্মপরিচয়ে ধুঁকতে থাকা বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশ, আত্মনির্মাণ ও আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠতম গৌরবদীপ্ত অধ্যায়টির নাম মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবন চেতনা, কর্ম পরিক্রমা এবং সার্বিক কর্মপ্রবাহে হীরকের মতোই দ্যুতিময়। এ কারণেই আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সবচেয়ে বড় প্রেরণার নাম মুক্তিযুদ্ধ। যদিও ইতিহাস বিকৃতির নানা আচ্ছাদনে, ধর্মীয় ও সা¤প্রদায়িক উসকানির ছদ্মাবরণে বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এটাই যে কোনো ক‚টকৌশলের কাছে ইতিহাস তার সৌন্দর্য ও সত্যকে বিলীন হতে দেয় না। যত বাধা এসেছে মুক্তিযুদ্ধ তত বেশি আমাদের শিল্প-সাহিত্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
রাজনীতির সাথে কবিতার সম্পর্কই বোধকরি সবচেয়ে স্পষ্ট এবং স্বীকৃত। দেশ-কালের যেকোনো সংকটে কবিরা সাহসী ভ‚মিকা পালন করেন এবং করেছেন। শোষন, নির্যাতন, নিপীড়ন, দুঃশাসন, মানবতার স্খলন এবং যাবতীয় প্রতারণা প্রবণতার বিরুদ্ধে কবিরা সর্বদাই সক্রিয়। কবিতার বিজয় কিংবা কবিতায় স্বাধীনতা যেভাবেই বলি না কেন বাংলাদেশের কবিতা আমার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে নিপুণ শক্তিতে, শৈল্পিক উচ্চারণে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র মহিমা ও আত্মত্যাগ বাংলাদেশের কবিদের কলমে অনুভূত হয়েছে আপন বোধ ও সৌন্দর্যে।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের কবিরা লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন শব্দের প্রতিরোধ নামক আগ্নেয়াস্ত্রে। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ কবি জসীমউদ্দীন ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ নামক কাব্য সংকলনের ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেনÑ
‘তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়/ আমরা বাঙালি মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।’
কবি সুফিয়া কামাল রক্ষণশীলতার কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে প্রগতিশীলতার পাঠ আত্মস্থ করেছিলেন ছেলেবেলাতেই। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তিনি দেখেছেন ‘মৃত্যুঞ্জয়’ হিসেবে। শহীদ সন্তানদের তিনি প্রবল স্নেহভরে সম্বোধন করেছেন ‘সোনারা আমার’ বলে।
চল্লিশ দশকের অন্যতম প্রধান কবি এবং প্রণম্য সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের কবিতায় স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের বিরল বিবরণ মেলেÑ
‘শব্দের মালায় আমি তোমাকে গাঁথতে চাই স্বাধীনতা। তুমি/ ঘরে-বাইরে এমন উলঝুল নৃত্যে মেতে আছো, কি আশ্চর্য/ আমার কলম/

বুকের মধ্যে/ তুমি/ মনোহর শব্দমালা’। (স্বাধীনতা)
আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতিটি অধ্যায় যার কবিতায় পেয়েছে ভিন্ন দ্যোতনা, মানুষ ও মানবতা যার কবিতায় উঠে এসেছে হৃৎপিÐের গভীর প্রদেশ থেকে। স্বাধীনতার
ত্যাগ-তিতিক্ষা, আকাক্সক্ষা-অনুরাগ যিনি গেঁথেছেন শব্দের অনন্য সৌরভে, তিনি বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমান। একাত্তরের সেই অবরুদ্ধ দিনগুলোতে রায়তলী গ্রামের পুকুরপাড়ে বসে এপ্রিলের কোনো এক দুপুরে তিনি লিখলেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং একই মাসে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। সীমান্ত পার হয়ে ভারত থেকে প্রকাশিত হলো এই অসাধারণ কবিতা যুগল যা মুহূর্তেই হয়ে উঠল স্বাধীনতাকামী অগণিত মানুষের কণ্ঠস্বর। কী অসাধারণ ব্যঞ্জনায় প্রতিধ্বনিত হলো মানুষের আকাক্সক্ষাÑ
‘সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান
কৃষক,/ কেষ্টদাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,/ মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,/ গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে/
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো/ সেই তেজী তরুণ যার পদভারে/ একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছেÑ/ সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’
এ ছাড়াও এই দশকের সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আল-মাহমুদ, শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরীসহ অনেকের কবিতাতেই মূর্ত হয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন ষাটের কবি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মাহবুব সাদিক প্রমুখ।
নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কী করে আমাদের হল’ আমাদের স্বাধীনতার সার্বিক চিত্রকেই যেন ফুটিয়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতাটি যেন বিজয়ের এক পূর্বাভাস। মহাদেব সাহার ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরিতে’, আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ মুক্তিযুদ্ধকালীন আত্মত্যাগ ও যন্ত্রণাকেই তুলে ধরে। জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখলেনÑ ‘তোমাদের হাড়গুলো বাংলার হৃৎপিÐে অবিনাশী ঝড়;/ বাঙালির জন্মতিথি, রক্তে লেখা ষোল ডিসেম্বর।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে তরুণ কবির কণ্ঠে সবচেয়ে বলিষ্ঠ স্বরে বেজে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের শব্দাস্ত্র, তিনি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, মঞ্চে উচ্চারিত সবচেয়ে উচ্চকিত কবিতা। এ ছাড়াও আসাদ চৌধুরী, অসীম সাহা, কামাল চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, বিমল গুহ, মাহমুদ কামাল, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, রেজাউদ্দিন স্টালিনসহ অসংখ্য কবি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় ও বাঙালির জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে কবিতা লিখেছেন। মাঝে মাঝে বৈরী বাতাসের ঝাপটা এসে আমাদের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তখনই প্রয়োজন হয় ইস্পাত-দৃঢ় প্রত্যয়ের। আর আমাদের স্বপ্ন আকাক্সক্ষা আর ঐক্যের প্রয়োজনে বারবার আশ্রয় নিতে হয় গর্বের শেষ আশ্রয় মুক্তিযুদ্ধের কোমলকমলে।

ষ কবি ও প্রাবন্ধিক





সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com