শব্দ দিয়ে শব্দাতীত একটা জগৎ নির্মাণ করাই কবিদের কাজ। কবিতার তাই নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকতে নেই, কবিতা হয়ে ওঠার ব্যাপার। তবুও যুগে যুগে কবিতাই তুলে ধরে জীবন ও সমাজ, হয়ে ওঠে মানবিক বোধের প্রতিবিম্ব। হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ডানায় ভর করে বাঙালি জাতির যে অগ্রযাত্রা তা কিন্তু প্রতিটি বাঁকে এসেই বিনম্র স্বস্তি অনুভব করেছে কবিতার কাছেই। বাঙালি জাতির সভ্যতা বিনির্মাণের যে গৌরবময় পথ, আর সময়ে সময়ে নিয়তি, প্রকৃতি আর বহিঃশত্রæর সাথে সংগ্রামের যে বিপুল ইতিহাস তা কবিতায় যাপিত হয়েছে অতি সন্তর্পণে। কবিতা তাই আমাদের ইতিহাস চেতনা, সভ্যতা আর সংস্কৃতির অন্তরালের অনুভব। হাজার বছর আত্মপরিচয়ে ধুঁকতে থাকা বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশ, আত্মনির্মাণ ও আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠতম গৌরবদীপ্ত অধ্যায়টির নাম মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবন চেতনা, কর্ম পরিক্রমা এবং সার্বিক কর্মপ্রবাহে হীরকের মতোই দ্যুতিময়। এ কারণেই আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সবচেয়ে বড় প্রেরণার নাম মুক্তিযুদ্ধ। যদিও ইতিহাস বিকৃতির নানা আচ্ছাদনে, ধর্মীয় ও সা¤প্রদায়িক উসকানির ছদ্মাবরণে বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এটাই যে কোনো ক‚টকৌশলের কাছে ইতিহাস তার সৌন্দর্য ও সত্যকে বিলীন হতে দেয় না। যত বাধা এসেছে মুক্তিযুদ্ধ তত বেশি আমাদের শিল্প-সাহিত্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
রাজনীতির সাথে কবিতার সম্পর্কই বোধকরি সবচেয়ে স্পষ্ট এবং স্বীকৃত। দেশ-কালের যেকোনো সংকটে কবিরা সাহসী ভ‚মিকা পালন করেন এবং করেছেন। শোষন, নির্যাতন, নিপীড়ন, দুঃশাসন, মানবতার স্খলন এবং যাবতীয় প্রতারণা প্রবণতার বিরুদ্ধে কবিরা সর্বদাই সক্রিয়। কবিতার বিজয় কিংবা কবিতায় স্বাধীনতা যেভাবেই বলি না কেন বাংলাদেশের কবিতা আমার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে নিপুণ শক্তিতে, শৈল্পিক উচ্চারণে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র মহিমা ও আত্মত্যাগ বাংলাদেশের কবিদের কলমে অনুভূত হয়েছে আপন বোধ ও সৌন্দর্যে।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের কবিরা লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন শব্দের প্রতিরোধ নামক আগ্নেয়াস্ত্রে। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ কবি জসীমউদ্দীন ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ নামক কাব্য সংকলনের ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেনÑ
‘তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়/ আমরা বাঙালি মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।’
কবি সুফিয়া কামাল রক্ষণশীলতার কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে প্রগতিশীলতার পাঠ আত্মস্থ করেছিলেন ছেলেবেলাতেই। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তিনি দেখেছেন ‘মৃত্যুঞ্জয়’ হিসেবে। শহীদ সন্তানদের তিনি প্রবল স্নেহভরে সম্বোধন করেছেন ‘সোনারা আমার’ বলে।
চল্লিশ দশকের অন্যতম প্রধান কবি এবং প্রণম্য সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের কবিতায় স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের বিরল বিবরণ মেলেÑ
‘শব্দের মালায় আমি তোমাকে গাঁথতে চাই স্বাধীনতা। তুমি/ ঘরে-বাইরে এমন উলঝুল নৃত্যে মেতে আছো, কি আশ্চর্য/ আমার কলম/