উনিশশ সাতচল্লিশ সালে দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভেঙে দুটি দেশ হলো। মুসলিমদের জন্য তৈরি হলো নতুন দেশ পাকিস্তান আর হিন্দুরা রয়ে গেল ভারতে। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দিল সে সময়ের সুবিধাভোগী কিছু মানুষ। হিন্দু এবং মুসলমানরা দুদেশের মধ্যে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অভিগমন শুরু করল। ঠিক এমনই এক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অমিতের পরিবার তাদের সমস্ত জমিজমা জলের দামে বিক্রি করে দিল। তারপর এক ভোররাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘরের মধ্যে হারিকেন জে¦লে রেখে, দরজা-জানালা বন্ধ করে রওনা দিল হিন্দুস্তানের দিকে। পরিবারটি প্রতিবেশী সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও জামে মসজিদের এক মুসলিম নেতার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।
নাশতার বেলা পার হলে পরিবারটি হাতেনাতে ধরা পড়ল টিলা বাজারের কাছে। দলবল নিয়ে সেই মুসলিম নেতা অমিত ও তার মা-বাবা, ভাই-বোনকে টানতে টানতে টিলা বাজারের মধ্যখানে নিয়ে দাঁড় করালÑ তারপর সমস্ত ট্রাঙ্ক, সুটকেস খুলে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল কত ভরি সোনা আর নগদ অর্থ নিয়ে পরিবারটি দেশত্যাগ করছে। ট্রাঙ্কের সমস্ত জামাকাপড় একটা একটা করে রাস্তার মধ্যে ফেলে দিল তারা। লজ্জা ঘৃণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল পরিবারটি। বাজারের প্রায় সকল মানুষ তাদের পরিচিত কিন্তু এই দুঃসময়ে কেউ কোনো কথা বলল না। বাজারের মানুষ চিড়িয়াখানার পশু-পাখি দেখার মতো অবাক ও আনন্দের সাথে উপভোগ করতে লাগল মুসলিম নেতাদের সকল কৃতকর্ম। বাতাসের আগে এই খবর পৌঁছে গেল মাজেদের কানে। মাজেদ পাগলের মতো একদৌড়ে বাজারে ছুটে এসে কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই অমিতের গালে ঠাস করে একটি চড় বসিয়ে দিল। বাজারে নীরবতা নেমে এলো, সমস্ত মানুষ চড়ের শব্দে ফিরে তাকাল দুজনের দিকে। মানুষগুলো কয়েক সেকেন্ড অমিত ও মাজেদের দিকে লক্ষ করে নিজেদের কাজে মনোযোগ দিল। অমিতের চোখে জল। কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইল তারা, অতঃপর দুবন্ধুর মনে ছবির মতো ভেসে উঠলÑ মারবেল খেলার মুহূর্ত, ডাঙ্গুলি খেলা, চারগুটি খেলা, নদীতে ঐলডুব খেলার কত সে মধুর স্মৃতি।
মাজেদ বন্ধুর পরিবারকে মুসলিম নেতাদের হাত থেকে রক্ষা করে একবুক অভিমান নিয়ে অমিতের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললÑ ‘কী করে পারলি আমাকে না জানিয়ে রওনা দিতে!’ অমিত মাজেদের কথার কোনো উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল, দেখল মাটির গর্ত থেকে আস্তে আস্তে লাল পিঁপড়াগুলো দল বেঁধে তার দুপায়ের ওপর দিয়ে মাথার দিকে উঠে আসছে। এমন সময় অমিতের মা মাজেদের মাথায় ¯েœহের হাত রেখে বলল, ‘বাবা মাজেদ, মুসলমানের ছেলে হলেও তুমি আমার সন্তানের মতো। বাবা, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা যেভাবে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে তাই পথের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গ্রামের কারও কাছ থেকে আমরা বিদায় নিতে পারিনি। তোমরা আমাদের ক্ষমা করো বাবা।’
অমিতের মায়ের কথা শুনে মাজেদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বাল্যবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে রাখল বেশ কিছুক্ষণ। বাঁধভাঙা জোয়ার নামল দুই বন্ধুর চোখে। চোখের জল মুছতে মুছতে তারা হাঁটতে শুরু করল সীমান্তের দিকে। বর্ডার পর্যন্ত বন্ধুকে এগিয়ে দিয়ে আসতে মাজেদও পা বাড়াল তাদের সাথে। কাঁচা মাটির রাস্তা, ধানের জমির আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটির পর একটি গ্রাম তারা পার হয়ে গেল ভয় আর একবুক শঙ্কা নিয়ে। পথে দেখা হলো তাদের মতো আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে। তারাও হেঁটে চলছে সীমান্তের দিকে। সঙ্গে তাদের ছেলে-মেয়ে, পোঁটলা-পুঁটলি,
মাথায় সংসারের বোঝা।
বেনাপোল বর্ডার পৌঁছাতে তাদের আরও দুই মাইল পথ যেতে হবে। দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পরিবারটি রাস্তার পাশের একটি বটগাছের ছায়ায় বিশ্রামে বসল। অমিতের মা পোঁটলার ভেতর থেকে চিড়া আর পাটালি গুড় বের করে সবাইকে খেতে দিল। শুকনো চিড়া মুখে দিতেই অমিতের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। মাজেদ জলের ঘটি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কী বন্ধু চারগুটি খেলা হবে নাকি এক দান?’ অমিত নিজের মাথাটা দুইবার ওপর-নিচ করল। সঙ্গে সঙ্গে মাজেদ মাটিতে দাগ কেটে একখানা চারগুটির কোর্ট কেটে নিল। তারপর দুই বন্ধু ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে চারগুটিতে দান চালা আরম্ভ করল। গ্রামীণ এই খেলার ঘোরে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গিয়ে তারা যেন ফিরে পেল তাদের ফেলে আসা বোকা শৈশবকে।
বেলা যখন মাথার ওপর তখন অমিতরা পৌঁছল বেনাপোল বর্ডারে। শত শত মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে বসে আছে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি বাংলাঘরে।
দল ধরে মানুষ এপারে আসছে, ওপারে ছুটে যাচ্ছে; মাঝখানে শুধু একটি কাঁটাতারের বেড়া। কাঁটাতারের ওপর দিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে, নদীর জল প্রবাহিত হচ্ছে, শুধু মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এই কঠিন ব্যবস্থা। অমিত ও মাজেদ দীর্ঘ নিশ^^াস ছেড়ে বর্ডারের মানুষগুলোকে একপলক দেখল। তারপর দুজনার চোখ আটকে গেল কাঁটাতারের বেড়ার ওপর! বর্ডার অতিক্রমের অনুমতির জন্য তারা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় বসে রইল।
মাথার ওপরের সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল তখন তারা বর্ডার অতিক্রমের অনুমতি পেল। সঙ্গে সঙ্গে অমিত তার মা-বাবা, ভাই-বোনকে সঙ্গে নিয়ে শত শত মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে পা বাড়াল কাঁটাতারের সীমানা পেরুতে। চোখের পলকে দুদেশের নোম্যান্সল্যান্ড পার হয়ে পরিবারটি চিরদিনের জন্য ভারতে চলে গেল। আর এদিকে সীমানার এপারে কাঁটাতার ধরে ছায়াবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে রইল অমিতের বাল্যবন্ধু মাজেদ।