আমিন ইকবাল
ইংরেজি বর্ষপঞ্জির শেষদিন আজ। বিদায় নিচ্ছে ২০২০ সাল। একটি বর্ষের বিদায় মানে নতুন দিনের আগমন; নববর্ষের সূচনা। আর নববর্ষ মানেই নতুন ভাবনা, নতুন স্বপ্ন। সচেতনরা নববর্ষকে স্বাগত জানায় নতুন স্বপ্নের প্রত্যাশায়। নিজেকে নতুন করে উপস্থাপনের বাসনায়। তবে, নতুন বছরের স্বপ্নপূরণে প্রয়োজন বিগত বছরের সঠিক মূল্যায়ন। ফেলে আসা দিনগুলোর হালখাতা মেলানো। একজন মুসলিম হিসেবে বিগত এক বছর আমার কী করার ছিল, আর কী করেছি, কতটুকু আমল করা দায়িত্ব ছিল, কতটুকু করতে পেরেছেÑ ইত্যাদি হিসাব মেলাতে হবে অতীত জীবনের ডায়েরি খুলে। জীবনের ডায়েরিতে ধরা পড়বে অসংখ্য ভুল। প্রভুর দরবারে সেসব ভুলের ক্ষমা প্রার্থনা করা বর্ষবিদায়ের প্রথম কাজ।
বিদায়ি বছর কী কী ব্যর্থতা ছিল, নতুন বছরে এসব ব্যর্থতা কীভাবে দূর করা যাবে, নতুন বছর ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কী করতে পারি, প্রতিটি সময় সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারব কি না, একজন মুসলিম ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে কী দাবি রাখেÑ এসব নিয়ে পরিকল্পনায় বসা দ্বিতীয় কাজ।
প্রতিটি ভালো কাজের নিয়ত করা জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা সফলতার পথ দেখায় আর খাঁটি নিয়ত কাজের গতি বৃদ্ধি করে। কাজের শুরুতে নিয়তের গুরুত্ব দিয়েছেন রাসুল (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয় প্রতিটি কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (বুখারি : ১/১)। অন্য হাদিসে আছেÑ ‘মুমিন বান্দার নিয়ত তার কর্মের চেয়ে উত্তম।’ (বাইহাকি : ১/৮)। তাই, নতুন বছরকে সামনে রেখে আমাদের নিয়ত ঠিক করতে হবে। পরিকল্পনা সাজাতে হবে। কাজের গতি বৃদ্ধি এবং সঠিকতার জন্য প্রয়োজনে বড়দের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। তাদের সঙ্গে নিজের চিন্তা শেয়ার করে ভালোটা গ্রহণ করা যেতে পারে।
ঈমানদার-মুসলিমের প্রথম পরিকল্পনা হওয়া চাই ‘আমল’ নিয়ে। জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে আমার নামাজ, রোজাসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো কীভাবে করব, দৈনিক কতটুকু কোরআন তেলাওয়াত করতে পারি, নফল নামাজ কয় রাকাত পড়তে পারি, নফল রোজা কয়টা রাখতে পারি, পরোপকার কীভাবে করতে পারি, দান-সদকা কীভাবে বাড়াতে পারি ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা করা। একই সঙ্গে নিজে বদ অভ্যাসগুলো ছাড়ার পরিকল্পনাও করা চাই। মিথ্যা বলা, গিবত করা, অন্যের ক্ষতি করা, দুর্নীতি করা ইত্যাদি থেকেও যেন আগামী এক বছর বেছে থাকতে পারিÑ সে অনুযায়ী ভাবনা স্থির করা। সর্বোপরি চিন্তা করাÑ এই বছর যেমনই কেটেছেÑ আগামী বছর যেন আমার আমলের খাতা নেকের দ্বারা আরও উজ্জ্বল হয়, আরও সমৃদ্ধ হয়। এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন সময়ের
যথাযথ গুরুত্ব ও মূল্যায়ন করা।
সময় জীবনের অমূল্য সম্পদ। সময়কে হেলায়-ফেলায় কাটিয়ে দিলে পরজগতে আক্ষেপের সীমা থাকবে না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সেখানে তারা (অপরাধীরা) চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের আবার দুনিয়ায় প্রেরণ করুন। আগে যা করেছি, তা আর করব না। তখন আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমাদের এতটা সময় দিইনি, যাতে উপদেশ গ্রহণ করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীরাও আগমন করেছিল। অতএব, আজাব আস্বাদন কর। জালেমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা ফাতির : ৩৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি, যে নিজের জীবনের হিসাব নেয় এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য পুঁজি সংগ্রহ করে।’ (মুস্তাদরাক)। ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, ‘তুমি সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার অপেক্ষা কর না এবং সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকাল পর্যন্ত জীবিত থাকার আশা কর না। আর সুস্থ থাকা অবস্থায় অসুস্থ সময়ের জন্য আমল করে নাও এবং জীবন থাকতে মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের পুঁজি সংগ্রহ কর।’ (বুখারি)
আমরা জানিÑ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর সময় খুবই অল্প। দেখতে দেখতে চলে যায় দিন। এ অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু প্রস্তুত করতে হবে। যোগাড় করতে হবে পরকালের পাথেয়। পৃথিবী হচ্ছে পরকালের শস্যক্ষেত। পরকালের ফসল ফলার জন্যই মহান প্রভু আমাদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। যেদিন পৃথিবীতে পরকালের ফসল ফলানো যাবে না, সেদিন পৃথিবীরও কোনো মূল্য থাকবে না। অতএব, দুদিনের দুনিয়ার চাকচিক্যের পেছনে না পড়ে, আমাদের মনোযোগী হতে হবে পরকালের ফসল ফলানোর কাজে। দুনিয়াতে যা কিছু ফলাবÑ পরকালে তাই আমার সম্বল হবে। অনন্তকালের সঙ্গী হবে।
ইংরেজি বর্ষ উদযাপনের নামে আমাদের সমাজে অশালীন ও আপত্তিকর কিছু চিত্র সামনে আসে। মুসলিম সমাজে এমনটা আদৌ কাম্য নয়। এ থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় এমন কিছু করা যাবে না নববর্ষ উদযাপনের নাম করে। এ জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে আমাদের অভিভাবক ও সরকারের দায়িত্বশীলরা যেন চোখ-কান খোলা রাখেন নতুন বছরের প্রথম রাতে।
সর্বোপরি কামনাÑ নববর্ষে আমাদের জীবন কল্যাণের প্রাচুর্যে ভরে উঠুক। শান্তিময় হয়ে উঠুক দেশ ও জাতি। মহান আল্লাহর রহমতে পূর্ণ হোক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। সর্বক্ষেত্রে আল্লাহই আমাদের সহায়। তার কাছেই আমাদের সব স্বপ্ন ও পরিকল্পনার মঙ্গল কামনা।
লেখক : আলেম ও প্রাবন্ধিক