মরণনেশা ইয়াবা যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। কঠোর অভিযান সত্তে¡ও থামছে না ইয়াবার কারবার। বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে জোয়ারের গতিতে ঢুকছে বড় বড় ইয়াবার চালান। গত এক সপ্তাহে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অভিযানে প্রায় প্রতিদিনই বড় বড় ইয়াবার চালান আটক হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও টেকনাফে পৃথক দুটি অভিযানে ১ লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবা আটক করে বিজিবি। এর বাইরেও রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশেই বেড়েছে ইয়াবা কারবারিদের তৎপরতা। শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযান চালিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতরে অভিনব কায়দায় রাখা ২৪ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা আটক করেছে এলিটফোর্স র্যাব।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্তমানে ইয়াবার চোরাচালান ব্যাপকহারে বেড়েছে। পাশাপাশি অভিযানে ইয়াবা উদ্ধার ও জড়িতদের আটকের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে পাশর্^বর্তী দেশ মিয়ানমার থেকেই দেদারসে আসছে মরণনেশা ইয়াবার বড় বড় চালান। সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থার কয়েক ধাপের নজরদারি এড়িয়ে ইয়াবার চালান ঢুকছে বাংলাদেশ সীমানায়। যার কিছুটা অংশ আটক হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। মূলত সীমান্ত ভাগ করা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবাগুলো টেকনাফ হয়ে সরবরাহ হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। এসব চালান আনা-নেওয়ায় ব্যবহৃত হচ্ছে প্রশিক্ষিত সাঁতারু থেকে শুরু করে নারী-শিশুরা।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মুখপাত্র লেফ. কর্নেল ফয়জুর রহমান সময়ের আলোকে শুক্রবার মোবাইল ফোনে জানান, মাদক কারবারিদের তৎপরতা বেড়েছে। পাশাপাশি অভিযানের মাত্রাও আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এলিটফোর্স র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফ. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সময়ের আলোকে জানান, ইয়াবার চালান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে কখনও কখনও বেশি পরিলক্ষিত হয়। সে অনুসারে অভিযানের মাত্রাও বাড়ানো হয়। র্যাব শুরু থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অভিযান চালিয়ে আসছে। মাদক প্রশ্নে কোনোরকম ছাড় নেই।
বর্তমানে ইয়াবা তৎপরতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আশিক বিল্লাহ বলেন, র্যাবের সমীক্ষায় দেখা যায় শীতকাল ও থার্টিফার্স্ট নাইটের পরপরই ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকের চাহিদা বাড়ে। চাহিদা বৃদ্ধির
ফলে স্বাভাবিকভাবে মাদক কারবারিরা বেশি তৎপরতা চালায়। যদিও এসব বিষয়ে র্যাব সার্বক্ষণিক নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, ইয়াবার একমাত্র উৎপাদন কেন্দ্র বা উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার। তাও আবার মিয়ানমারের অভ্যন্তরের এসব ইয়াবা কারখানার বেশিরভাগ বাংলাদেশের সীমান্তের অদূরবর্তী এলাকায় স্থাপন করা। এসব নিয়ে বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বারবার মিয়ানমারকে ইয়াবা বন্ধে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে বললেও তারা সাড়া দিচ্ছে না। মূলত মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণেই ইয়াবা নির্মূল অনেকটাই কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ঘেঁষা মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা তৈরির ৪৯টির মতো কারখানার সন্ধান রয়েছে। যার মধ্যে ৩৭টির নাম ও ঠিকানা এবং মিয়ানমারের ১২ জন ইয়াবা কারবারির নাম লিখিতভাবে গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট ডিভিশনে (ডিইডি) জমা দেওয়া হয়। এসব কারখানা থেকে ১৭ ধরনের ইয়াবা বাংলাদেশে পাচার হয়ে থাকে বলে জানা যায়।
টেকনাফে ৩০ হাজার ইয়াবা আটক : গত বৃহস্পতিবার রাতে বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অভিযানে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। বিজিবি জানিয়েছে, বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়নের আওতাধীন টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ অভিযান চালায়। তথ্যানুযায়ী টেকনাফের লেদা বিওপির বিশেষ টহল দল দ্রæত লেদা এলাকায় বেড়িবাঁধের পেছনে গোপনে অবস্থান নেয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিজিবির টহল দল একজন দুষ্কৃতকারীকে নাইট ভিশন ডিভাইসের মাধ্যমে দেখতে পায়Ñ সেখান থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে এবং লেদা খালের ১০০ গজ পূর্ব দিক দিয়ে একটি বস্তা কাঁধে করে নাফ নদের কিনারা হয়ে আসছে। টহল দল তাকে চ্যালেঞ্জ করে খুব দ্রæত অগ্রসর হতে থাকলে ওই দুষ্কৃতকারী দূর থেকেই বিজিবিকে অনুধাবন করা মাত্রই বহনকৃত বস্তাটি ফেলে দ্রæত কুয়াশা ও অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে লেদা খালের আড় ব্যবহার করে নাফ নদ সাঁতরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে টহল দল পৌঁছে তল্লাশি চালিয়ে একটি প্লাস্টিকের বস্তার ভেতর থেকে ৩০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে। বিজিবি জানিয়েছে, আটক ইয়াবার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৯০ লাখ টাকা।
বিজিবি সূত্রে আরও জানা যায়, একই রাতে বিজিবির আরেকটি অভিযানে ৯০ হাজার পিস উদ্ধার করা হয়। বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের (২ বিজিবি) দমদমিয়া বিওপির বিশেষ টহল দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালনা করে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া বিওপির দায়িত্বপূর্ণ জালিয়ারদ্বীপ এলাকা দিয়ে ইয়াবার একটি বড় চালান পাচারকালে ওই ৯০ হাজার ইয়াবাসহ দুজনকে আটক করে বিজিবি।
এর আগে ১২ জানুয়ারি রাতে বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়ন পৃথক দুটি অভিযানে ৩ লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবার বিরাট দুটি চোরাচালান আটক করে।
বিজিবি জানায়, আটক এই ইয়াবার মূল্য প্রায় ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তার আগে ১১ জানুয়ারি দেশের অন্য সীমান্ত এলাকা সোনামসজিদ বিওপির বিশেষ দল সীমান্ত পিলার ১৮৫/১-এস থেকে আনুমানিক এক কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সোনাপুর গ্রামে রহিমের আমবাগান থেকে ৭ হাজার ৯৮৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। তবে বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে ইয়াবা কারবারি বা বহনকারী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
রাজধানীতে গ্যাস সিলিন্ডারে প্রায় ২৫ হাজার ইয়াবা : র্যাব-২ ব্যাটালিয়ন জানায়, মাদক ব্যবসায়ীর একটি চক্র কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে একটি প্রাইভেটকারে করে ইয়াবার একটি বড় চালান নিয়ে রাজধানীতে আসছিল। চালানটি ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় রাত ১২টায় হস্তান্তর হওয়ার কথা ছিল। এই গোপন খবরে যথাসময়ে কারওয়ান বাজারের বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের গেটের সামনে গোপনে অবস্থান নেয় র্যাব। কিছুক্ষণ পর সেখানে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস আসামাত্র সেটিকে আটক করা হয়। পরে তল্লাশি করে মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারেরর ভেতর বিশেষভাবে লুকিয়ে রাখা ২৪ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবাসহ উপস্থিত জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলোÑ মোহাম্মদ আলী হোসেন, জাকির হোসেন ও জুয়েল হোসেন। এ সময় ইয়াবা বহনকারী প্রাইভেটকারটিও জব্দ করা হয়। গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, চক্রটি দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এসব ইয়াবা ঢাকায় আনে। তারা ইয়াবাগুলো আনার আগে গ্যাস সিলিন্ডার কেটে ইয়াবা ভরে আবার ঝালাই করত। এভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা বহন করে আসছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১ হাজার পিস ইয়াবাসহ আসমা নামে এক নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগ। এ ছাড়া র্যাব-৪ ব্যাটালিয়নের পৃথক অভিযানে গতকাল মিরপুর পীরেরবাগ এলাকার পাকা রাস্তার ওপর থেকে ৪৮১ বোতল ফেনসিডিলসহ দীন ইসলাম নামে এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। এ ছাড়া ফেনসিডিল ও মাদক আইসসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তারা হলোÑ আসমা বেগম, আশরাফুর রহমান ওরফে সবুজ, সুমন খন্দকার ওরফে চিকু সুমন, সোহেল রানা ও নাহিদ আলম সজল। বৃহস্পতিবার পৃথক অভিযানে তাদের গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ।
পুতুলের পেটে ১৮ হাজার ইয়াবা
সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বাসে ও ট্রেনে ফেরি করে খেলনা পুতুল বিক্রি করতেন একদল হকার। এর আড়ালে চলত ইয়াবার ব্যবসা। কৌশলে পুতুলের মধ্যে ইয়াবার বড়ি ভরে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে বিক্রি করত। এভাবেই ইয়াবা বড়ি বিক্রির অভিযোগে শুক্রবার সাতজনকে আটক করেছে র্যাব। জব্দ করা হয়েছে ইয়াবার ১৮ হাজার বড়ি।
মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক পাচারে ভিন্ন ভিন্ন বিকল্প পথ আবিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে প্রশাসনও তাদের কৌশলে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। শুক্রবার ভোর ৪টার সময় সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে খেলনা পুতুলের ভেতর থেকে ১৮ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ টাকাসহ ৭ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১১-এর একটি চৌকস দল।
শুক্রবার বিকালে র্যাব-১১-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার সুমিনুর রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, গ্রেফতাররা সবাই মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার বাসিন্দা। তারা নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ীভাবে বাসা ভাড়া নেয়। ইয়াবা ব্যবসার সুবিধার্থে তারা একেক সময় একেক জায়গায় অবস্থান করে। খেলনা পুতুল ফেরি করে বিক্রির ছলে তারা পুতুলের ভেতর ইয়াবা পাচার করত। বাস কিংবা ট্রেনে ফেরি করে বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা বিক্রি করার আড়ালে খেলনার ভেতরে ইয়াবা ট্যাবলেট বিভিন্ন স্পটে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে পাচার করত বলে প্রাথমিকভাবে র্যাবের কাছে স্বীকার করেন তারা। গ্রেফতারকৃতরা হলো, মো. জানু মাল (৩৯), মো. আশরাফুল (৫০), মো. রাজু সরদার (২২), মো. ইসলাম মাল (৩২), মো. তাহিদ হোসেন (২৬), শহিদুল ইসলাম (২৬) ও মো. শরৎ আলী। গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানায় র্যাব।