দেখতে দেখতে কেটে গেল দুটি বছর। ফেনীর সোনাগাজীতে আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার সেই বীভৎস ঘটনা ভুলতে পারেননি স্বজনরা। রাফীর আগুনে পোড়া শরীরটা আজও ভাসে মায়ের চোখের সামনে। থেকে থেকেই আঁতকে উঠেন রাফীর মা শিরিনা আক্তার। এখনও মনের অজান্তেই অনেক সময় খুঁজে ফেরেন নয়নের মণি একমাত্র আদরের কন্যা রাফীকে। কিন্তু রাফী এখন কেবলই স্মৃতি। এখন অপেক্ষা কেবল অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর দেখার। বৃহস্পতিবার আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের দুই বছর উপলক্ষে নুসরাত জাহান রাফীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সুনসান নীরবতা। রাফীর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তায় তিনজন পুলিশ সদস্য বাড়ির প্রবেশমুখে পাহারায় ছিল। নিয়মিতই এভাবে পরিবারটিকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে রাফী প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে তার মা শিরিনা আক্তার কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘আজ দুই বছর আমি আমার মেয়ের কণ্ঠে মা ডাকটি শুনতে পাই না। রাতে ঘুম হয় না। কারণ আমার মেয়ের হাত-পা বেঁধে যখন তারা আগুন লাগিয়েছিল, তখন আমার মেয়ে কী করেছিল? সেটাই বারবার মনে হয়। সেদিন আমি খবর পেয়ে ফেনী সদর হাসপাতালে ছুটে যাই, তখন পুলিশ সদস্যরা আমার মেয়ের খুব কাছে ভিড়তে দেয়নি। কিছুটা দূর থেকেই দেখেছিলাম। তার পুরো শরীর ব্যান্ডেজ করে ফেলে ডাক্তাররা। পুলিশ আমাকে বলেছিল তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাঁচে কি না, সন্দেহ। আপনি মেয়ের আগুনে পোড়া এই শরীর দেখলে সহ্য করতে পারবেন না। ডাক্তাররা আপনাকে দূরে থাকতে বলেছে। তখন আমার মেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। আজও মেয়ের আগুনে পোড়া শরীরটা আমার চোখে ভাসে।’
শিরিনা আক্তার বলেন, ‘আমার নিষ্পাপ মেয়েটিকে যারা এমন কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছে তাদের দ্রুত শাস্তি কার্যকর হলে কিছুটা হলেও ভালো লাগবে। সরকারের কাছে এটাই আমার চাওয়া, রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক।’
২০১৯ সালের ২৭ মার্চ আলিম পরীক্ষার্থী রাফীকে যৌন নিপীড়ন চেষ্টার দায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা রাফীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রাফীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনাটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-সমালোচনার ঝড় তোলে। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ মানুষ। ৬১ কার্যদিবসে গত বছরের ২৪ অক্টোবর অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এ ছাড়া প্রত্যেক আসামিকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানাও করেন আদালত। বর্তমানে বিচারিক আদালতের রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন্দ সরকার ও বিচারপতি শাহেদ নুর উদ্দিনের বেঞ্চে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহমান সময়ের আলোকে জানান, এখনও মাঝেমধ্যে রাফীর বাবা, মা ও দুই ভাই তার স্মৃতি রোমন্থন করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। এলাকাবাসীও এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর চায়।
মামলার বাদী রাফীর বড়ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমরা আদালতের প্রতি শতভাগ আস্থাশীল। নিম্ন আদালতে আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। আশা করছি উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায়বিচার পাব। রায় দ্রুত কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’ মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘এখনও মাঝেমধ্যে আসামিদের স্বজনরা নানাভাবে হুমকি দেওয়াসহ অনেক রকম কর্মতৎপরতা চালায়। এসব নিয়ে আমরা অনেক সময় আতঙ্কগ্রস্তও হয়ে পড়ি।’
সোনাগাজী মডেল থানার ওসি সাজেদুল ইসলাম জানান, রাফীর পরিবারের নিরাপত্তায় ঘটনার শুরু থেকে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে।
রাফী হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলোÑ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদ্রাসার তৎকালীন গভর্নিং বডির সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন। এর মধ্যে অন্য মামলায় গ্রেফতার থাকায় ফেনী কারাগারে রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম এবং বাচ্চাসহ কামরুন নাহার মনি চট্টগ্রাম কারাগারে থাকলেও বাকি আসামিরা কুমিল্লা কারাগারে রয়েছে।