ই-পেপার বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪

মহানবীর (সা.) রমজান যাপন
প্রকাশ: রবিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২১, ১০:০৪ পিএম  (ভিজিট : ২৪৩)
রমজান হলো স্রষ্টার সমীপে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাস। অবারিত রহমত, বরকত ও ক্ষমায় সিক্ত হওয়ার মাস। মুমিনের আমলের ভরা বসন্ত। এ বসন্তের পবিত্র পরশে সেজে ওঠে মুমিনের আমলের সোনালি জীবন। মাহে রমজানের প্রতিটি আমলের পরতে পরতে মুমিনের অতৃপ্ত আত্মা খুঁজে ফেরে তৃপ্তির খোরাক। মহিমান্বিত এ মাসে নিবিড় ঐকান্তিকতায় মহামহিম রবের পরম সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় সর্বান্তঃকরণে নিজেকে সফলভাবে সমর্পণ করার শিক্ষা দিয়েছেন মহানবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মাহে রমজানের পবিত্র আবেশ জড়িয়ে অন্তঃকরণের পরিশুদ্ধি, পার্থিবতায় সর্বাঙ্গ আরোপণ থেকে মনোজগতকে বিমুক্তকরণ, বস্তুকেন্দ্রিকতার রাহুগ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করে পরকালমুখিতার সার্বক্ষণিক চর্চার ক্ষেত্রে হেদায়াতের এক প্রদীপ্ত সোনালি পথ রেখে গেছেন উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের জন্য। সফল-সার্থক রোজাদার হিসেবে আসমানি
স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কী কী করতে হবেÑ তা আমল করে করে দেখিয়ে গেছেন তিনি। সালাত-তিলাওয়াত, সেহরি-ইফতারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে রয়েছে সে সোনালি শিক্ষার পবিত্র পরশ।
সেহরি : রোজার জন্য সেহরি গ্রহণ করা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত এবং অত্যন্ত বরকতময় কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতের শেষ প্রহরে সেহরি গ্রহণ করতেন। উম্মতকেও সেহরি গ্রহণের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেহরি গ্রহণ করো, কেননা সেহরিতে বরকত রয়েছে।’ (বুখারি : হাদিস ১৯২৩; মুসলিম : হাদিস ১০৯৫)। কাতাদা (রহ.) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, (একদিন) রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং যায়েদ বিন সাবেত (রা.) একসঙ্গে সেহরি খেলেন, সেহরি শেষ করে নবীজি (সা.) (ফজরের) নামাজ পড়তে উঠে গেলেন। (কাতাদা বলেন) আমরা হজরত আনাসকে (রা.) জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাদের সেহরি শেষ করা ও ফজরের নামাজ শুরু করার মধ্যে সময়ের ব্যবধান কতটুকু ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, ৫০ অথবা ৬০ আয়াত পড়তে যতক্ষণ সময় লাগে।’ (বুখারি : হাদিস ৫৭৬)।
৫০-৬০ আয়াত বলতে মধ্যম ধরনের আয়াত, যা তেলাওয়াতে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগবে। সে আলোকে রাতের একেবারে শেষ প্রহরে সেহরি খাওয়া ছিল রাসুলুল্লাহর (সা.) আমল। তাই রাতের শেষ প্রহরে সেহরি খাওয়া সুন্নত।
ইফতার : ইফতার গ্রহণ করা সুন্নত এবং স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালবিলম্ব না করে ইফতার করতেন এবং উম্মতদের দ্রুত ইফতার গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যতদিন পর্যন্ত (আজানের পর) দ্রুত ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অতএব তোমরা দ্রুত ইফতার করো, কেননা ইহুদিরা ইফতার করতে দেরি করে থাকে।’ (সুনানু ইবনে মাজাহ : হাদিস ১৬৯৮)। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে সেই বেশি প্রিয় যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে।’ (তিরমিজি : হাদিস ৭০০)। খেজুর বা খুরমা দিয়ে ইফতার করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাধারণত খেজুর বা খুরমা দিয়ে ইফতার করতেন। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) (মাগরিবের) নামাজের আগে খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, খেজুর না থাকলে খুরমা দিয়ে ইফতার করতেন, তাও না থাকলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন।’ (আবু দাউদ : হাদিস ২৩৫৬; তিরমিজি : হাদিস ৬৯৬)
ইফতারের দোয়া : ইফতারের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন, ‘জাহাবাজ জামাউ; ওয়াবতালাতিল উরুকু; ওয়া ছাবাতাল আঝরু ইনশা আল্লাহ।’ অর্থাৎ (ইফতারের মাধ্যমে) পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াব ও স্থির হলো।’ (আবু দাউদ : ২৩৫৭)। হজরত মুয়াজ ইবনে যুহরাহ বলেন, আমার নিকট এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন, তখন এ দোয়া পড়তেনÑ ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু, ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেওয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করছি।’ (আবু দাউদ : ২৩৫৮)
দান-সদকা : প্রিয় নবীজি (সা.) স্বভাবগতভাবেই মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল ছিলেন। রমজান মাস এলে তাঁর দানের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যেত। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি ছিলেন... রমজান মাসে হজরত জিব্রাইলের (আ.) সঙ্গে সাক্ষাৎকালে কল্যাণবহ মুক্ত বায়ুর চেয়ে বেশি দানশীল হতেন।’ (বুখারি : ৩২২০)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে প্রত্যেক সাহায্য প্রার্থীকে দান করতেন।’ (শুয়াবুল ইমান)। মাহে রমজানে রাসুলুল্লাহর (সা.) দানশীলতার শ্রেষ্ঠত্বকে আরব কবিরা এই মর্মে উল্লেখ করেছেনÑ ‘তিনি পূবালী হাওয়া আর কল্যাণবহ বায়ুর চেয়েও অধিকতর দানশীল।’
কোরআন তেলাওয়াত : প্রিয় নবীর (সা.) ওপর মহান আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। নবীজির অন্যতম দায়িত্ব ছিল উম্মতকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনানো। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সে দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রমজান এলে প্রতি রাতে নবীর (সা.) নিকট জিব্রাইল (আ.) আসতেন এবং একে অপরকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। (বুখারি : ৩৫৫৪)
সহিহ বুখারির বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার ইবনে বাত্তাল (রহ.) বর্ণনা করেন, আব্দুল ওয়াহিদ (রহ.) বলেছেন, কোরআন তেলাওয়াতের জন্য রমজানের প্রতি রাতে জিব্রাইলের (আ.) আগমন রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের বিশেষ ফজিলতের ব্যাপারে শক্তিশালী দলিল। রমজানে মানুষের ব্যাপকভাবে কোরআন তেলাওয়াতে দিকে মনোনিবেশ করা মূলত এখান থেকেই নেওয়া। যেহেতু নবীজি (সা.) করেছেন, তাই তাঁর অনুসরণে উম্মতগণও করে থাকেন। (শরহু ইবনু বাত্তাল : ২৩/৪)
নফল নামাজ : নবীজি (সা.) রমজানে এবং রমজানের বাইরে রাতের শেষ প্রহরে বিতর-তাহাজ্জুদসহ এগারো বা তেরো রাকাত নামাজ আদায় করতেন। মহান রবের প্রেমে সিক্ত হয়ে দীর্ঘ সময় নামাজে কাটিয়ে দিতেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, রমজান কিংবা অন্য সময়ে তিনি (রাতে) ১১ (অন্য বর্ণনায় ১৩) রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে চার রাকাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হতো অতুলনীয়; অতঃপর চার রাকাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যও হতো অতুলনীয়। এরপর তিন রাকাত আদায় করতেন। আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসুল! আপনি বিতির আদায়ের আগেই ঘুমাবেন? তিনি বললেন, হে আয়েশা! আমার দুচোখ ঘুমায়, কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।’ (বুখারি : ২০১৩)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ রাকাত তারাবি আদায় করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) রমজানে বিশ রাকাত (তারাবি) ও বিতির আদায় করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৭৭৭৪; তবারনি : ১২১০২)
ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন, ওলামায়ে-কেরাম রমজানে রাতের নামাজের ব্যাপারে ইখতিলাফ করেছেন। এক্ষেত্রে অধিকাংশ ওলামায়ে-কেরাম হজরত উমর (রা.), হজরত আলী (রা.) ও অন্যান্য সাহাবায়ে-কেরামের যে বিশ রাকাতের মতÑ তা গ্রহণ করেছেন। এটাই ইমাম ইবনুল মোবারক, সাওরি ও শাফির অভিমত। (তিরমিজি : ১৬২/২)।
ইতিকাফ : রমজানে রাসুলের (সা.) অন্যতম ধারাবাহিক ও গুরুত্বপূর্ণ আমল ছিল ইতিকাফ করা। আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রমজানের শেষ দশকে নবীজি (সা.) ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি : ২০৩৩)। এমনকি জিহাদের সফরের কারণে এক রমজানে তিনি ইতিকাফ করতে পারেননি, তবে পরবর্তী বছর ২০ দিন ইতিকাফ করে তা পূর্ণ করে নিয়েছেন। এই মর্মে সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, ‘নবী কারিম (সা.) প্রতি রমজানে দশ দিনের ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন।’ (বুখারি : হাদিস ২০৪৪)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রিয় নবীর দেখানো পথে রমজান যাপন করে পরকালের যথাযথ পাথেয় সংগ্রহের তাওফিক দান করুন। আমিন।




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close