ই-পেপার শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ধর্ম ও নৈতিকতার কথকতা
প্রকাশ: বুধবার, ৫ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম  (ভিজিট : ১১৫৩)
শেখ আনোয়ার
বিশ^জুড়ে চলছে ভয়াবহ করোনা মহামারি কাল। এ সময়ে যেন বিজ্ঞানের অভাব, আকাল। ডিজিটাল যুগে এসে মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মননে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রাকৃতিক, আধুনিক অপেক্ষা মধ্যযুগীয় অপ্রাকৃতিক, অতিপ্রাকৃত ধারণাগুলো মানুষের চিন্তাকে অধিক প্রভাবিত করছে। শাসন ব্যবস্থায় প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত বিশ^াস নিয়ে এখনও বিশে^র নানা দেশে ঘটে চলেছে সহিংসতা ও দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি স্বার্থ, ধর্মীয় গোষ্ঠী স্বার্থ এবং আঞ্চলিক সামষ্টিক স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে শক্তি প্রয়োগ ও সংঘাতের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমষ্টির ওপর আঘাত হেনে সাধারণ জনগণের মনে ভীতির আবহ তৈরি করা হচ্ছে।
দাঁত নেই, নখ নেই, হিংসা নেই
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে একদল ধর্মীয় লেবাসধারী তথাকথিত নীতিবান তেজি মানুষ আবির্ভূত হয়েছে। এদের মুখে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠে ধর্মীয় অমৃতবাণীযুক্ত রাজনীতির কথকতা। মুখে বলে ইসলাম শান্তির ধর্ম। বেশভূষায় অবাঙালি, আফগানিস্তানি, পাকিস্তানি-তালেবান। তারা পাকিস্তানি ভিন্ন দর্শন-সংস্কৃতিতে বিশ^াসী। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও তারা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গায় না! বাস্তবে তারা যেসব নীতিহীন কর্ম করে বেড়ায় তাতে শান্তির লেশমাত্র নেই। ভাব দেখায় তারা বেশ ধর্মপ্রাণ বা ধর্মভীরু। এরা সাধারণ মানুষের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য। সহজ সরল মানুষ ভাবে, অহরহ ধর্মের কথা বলা মানেই মানুষটা দয়ালু। দাঁত নেই, নখ নেই, হিংসা নেই। রয়েছে শুধু দয়া-মায়া আর ভালোবাসা। আজকাল তারাও মানুষের পাশে থাকতে চায়। মানুষের কাজ করতে চায়। তারা ধর্মের নামে সাধারণ মানুষের ভেতর ঢুকে মধ্যযুগীয় অপবিজ্ঞানের চাষ করে। এরা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে, রাজনৈতিক দল না হয়েও ধর্মীয় সংগঠনের ছদ্মবেশে জঙ্গি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। এই বর্বর জঙ্গি উগ্র গোষ্ঠী দেশের সম্পদে আঘাত হেনে সরকার ও জনগণের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে আধুনিক যুগে বর্বর জংলি দস্যুর মতো ফায়দা লাভের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।
আদর্শ শান্তিপূর্ণ সমাজ
কে না জানে, মানুষের জীবনের অনেক নৈতিকতা বোধই ধর্ম থেকে উৎসারিত এবং ধর্মশাস্ত্রে সংজ্ঞায়িত। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে অবাধ যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে সমাজজীবনে শৃঙ্খলা আনতে দেশে দেশে পরিবার প্রথা বা আইনের উদ্ভব। বিবাহ-বহির্ভূত যৌনাচার অনৈতিক। এ চেতনার মূল প্রোথিত রয়েছে ধর্মশাস্ত্রে। শুধু যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক জীবনের সার্বজনীন নৈতিকতা, যেমনÑ মিথ্যা না বলা, চুরি না করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট না করা, ঘুষ না খাওয়া, মানুষ হত্যা না করা ইত্যাদি পৃথিবীর তাবৎ ধর্মগ্রন্থ আত্মস্থ করে পাপ-পুণ্যের আলোতে ধর্মীয় নৈতিকতাগুলো অনুশাসনে রূপান্তরিত করেছে। এই অনুশাসনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাইÑ সুশাসন। অর্থাৎ আদর্শ শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টা। কিন্তু না। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে উগ্রপন্থিদের সহিংসতা ও তাণ্ডবের পর সমাজবিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন জেগেছেÑ তাদের শিক্ষা ও অনুশাসন সমাজে নৈতিকতাবোধ উজ্জীবনে কতটা সমর্থ? বাংলাদেশের এমন পরিবেশ যেন ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণ ছুঁয়ে যায়।
হাজার বছর আগে
বর্তমানে দেশের এহেন পরিবেশে যে বইটি আমি আবার পড়ছি এবং প্রায় বারবার পড়ছি, সেটা সাড়ে পাঁচশ বছরের পুরনো রাজনীতি বিজ্ঞানের বই। ইতালিয়ান প্রজ্ঞার অনন্য নিদর্শন, নিকোলো মাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’। হাজার বছর আগে প্রাচীন মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্র ও গির্জা কর্তৃক শাসিত খ্রিস্টীয় ধর্মের সাম্রাজ্যের অধীনে মানুষ ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ধর্মীয় বিশ^াসের নামে প্রাচীন গ্রিসের যুক্তিবোধ উপেক্ষিত হতে থাকে। শাসনের নামে চলতে থাকে গির্জার স্বেচ্ছাচার। রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই ধর্মীয় কুশাসনের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গির্জার ক্ষমতা সীমিত করার দাবি আসতে থাকে। তখনকার যুগে সাধারণভাবে বিশ^াস করা হতো যে, ‘পার্থিব ক্ষমতা হিসেবে রাষ্ট্রধর্ম, নৈতিকতা, ঐশ^রিক আইন, প্রাকৃতিক আইনের চেয়ে উচ্চতর ক্ষমতার অধীন।’ এসব ক্ষমতাকে ছেড়ে-ছুড়ে ফেলে দেন আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ম্যাকিয়াভেলি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের শ^াসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে তিনি ঘোষণা দেন, ‘এগুলো সব বাজে কথা। রাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং তার ওপর কোনো উচ্চতর ক্ষমতা থাকতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে রাষ্ট্র তার উন্নয়ন, অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা সম্প্রসারণের জন্য যা কিছু অনুকূল, তাই করতে পারে। এতে ধর্ম বা নৈতিকতা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।’
শিয়াল ও সিংহের গল্প
ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শনে কোনোরূপ রাখঢাক, আড়াল বা মারপ্যাঁচ নেই। তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, রাজনীতিকদের গুরু হলো অরণ্যের দুটো প্রাণী। কথাটা ভুললে চলবে না। একটা প্রাণীর নাম হলো সিংহ। অন্যটা শিয়াল। এই দুটো প্রাণীর কাছে জীবনদর্শনের দীক্ষা নিতে বলেছেন শাসককে। নেতারা সিংহ এবং শিয়াল দুজনকেই তাদের মাস্টার মশাইয়ের আসনে বসান। সিংহেরটা প্রবল পরাক্রম। কিন্তু তারা ফাঁদে পড়ে। কোথায় ফাঁদ তা বোঝার ভেদবুদ্ধি সিংহের নেই! শিয়ালের আশ্চর্য ক্ষমতা, ফাঁদ এড়িয়ে চলার। তাই রাজনীতিককে একই সঙ্গে সিংহ এবং শিয়াল দুটোই হতে বলেছেন। তবেই শুধু ধারাবাহিক উন্নয়নের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। যে নেতারা সিংহের মতো শুধু হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেন, তাদের ব্যাপারে ম্যাকিয়াভেলি বলেন, ‘তারা আসলে স্টুপিড! ঠিক সময়ে ফাঁদে পড়ে শেষ হবে তারা।’ বইটায় সদ্য সিংহাসনে আসীন তরুণ যুবরাজদের উপদেশ দেওয়া হয় এভাবেÑ ‘সিংহের মতো বলিষ্ঠ এবং শৃগালের মতো ধূর্ত হও। তোমার যারা সত্যিকারের শত্রু, তাদের চিনে রাখ। তাদের তো বটেই, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিশ্চিহ্ন করে দাও। যেন তুমি শাসন করতে পার নির্ভাবনায়। মনে রেখ, শাসকের পক্ষে নিষ্ঠুরতার অপবাদ কোনো অপবাদ নয়। বরং সেটাই সঠিক প্রশংসা।’ এমনই মারাত্মক স্পষ্টবাদী ম্যাকিয়াভেলি!
জানতে হলে পড়তে হবে
ম্যাকিয়াভেলি বলেন, ‘মানুষের স্বাভাবিক হীন চরিত্রকে সামষ্টিক ভালোতে পরিণত করার সবচেয়ে ভালো হাতিয়ার হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং সেদিক দিয়ে তা অন্য কোনো উচ্চতর ক্ষমতার অধীন হতে পারে না। তাই শাসনক্ষমতার বৈধতা কোনো নৈতিকতার মাপকাঠিতে আবদ্ধ নয়। কর্তৃত্ব আর ক্ষমতাই এখানে মূল বিষয়। যার ক্ষমতা রয়েছে সে-ই শাসন করবে। নৈতিকতা কাউকে ক্ষমতায় বসায় না। ক্ষমতা অর্জন আর ক্ষমতা রক্ষা করাই রাজনীতির মূলনীতি। ক্ষমতার উপযুক্ত ব্যবহার দিয়েই জনগণের আনুগত্য অর্জন করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। সামষ্টিক ভালোর জন্য কোনো কাজ করতে গেলে নৈতিক-অনৈতিক বিবেচনার কোনো প্রয়োজন নেই।’ গবেষকদের প্রশ্ন, নৈতিকতার স্থান না রেখে কীভাবে তিনি রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী করতে চান? তবে কি তিনি অনৈতিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও রাজনীতির পক্ষপাতী ছিলেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উত্তরÑ জী না! তিনি কখনই তার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদর্শের ওপরে অনৈতিকতার স্থান দেননি। ম্যাকিয়াভেলি যা-ই বলেছেন তার মূল লক্ষ্য ছিল একটা আদর্শ শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন। সেই বিজ্ঞানটুকু স্বচ্ছতায়, সহজ ভাষায় ও দৃঢ়তায় লিখেছেন তার অমর বইতে। জানতে হলে পড়তে হবে দ্য প্রিন্স। চোখ রাখতে হবে বইয়ের পাতায় পাতায়। আরেকটু গভীরে।
ধারাবাহিক উন্নয়নে করণীয়
দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘ শাসনের ওপর বরাবরই জোর দিয়েছেন ম্যাকিয়াভেলি। শাসককে তার শাসন ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কীভাবে কাজ করতে হয় তার বিস্তারিত গোপন কথা রয়েছে ‘দ্য প্রিন্স’ বইতে। তিনি বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে সফলতা পেতে চাইলে সময়ের সঙ্গে আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। গৎবাঁধা মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ নিয়মনীতি বা আইন-কানুনের আধুনিকিকরণ না করে বরং তা পোষণ এবং তোষণ করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা অচল এবং অপরিমিত হয়ে পড়ে। ফলে সেই আইন একসময় কালাকানুন হয়ে যায়। এবং তা সরকার ও সুশাসনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।’ ম্যাকিয়াভেলির মতে, ‘সাধারণ মানুষ নদীর স্রোতের মতো। তাকে প্রবাহিত করে শাসক শ্রেণির আবহাওয়া। একটা পরিবার, একটা অফিস যেমন কর্তার মতানুযায়ী চলে। তেমনি একটা রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির তৈরি আইন-কানুন, শাসন ব্যবস্থাই সে দেশের মানুষগুলোর প্রতিবেশ নির্মাণ করে।’ এলিট শ্রেণির শাসন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এসব ভদ্দর লোকেরা তাদের সম্পদ থেকে আহরিত লভ্যাংশের ওপর আলস্যপূর্ণ জীবনযাপন করে। কিন্তু সমাজের আদৌ কোনো উপকার করে না। সরকারি দলের সঙ্গে থাকার ভাব নিয়ে থাকলেও তারা সর্বত্র সরকারি শাসনের দুশমনিতে লিপ্ত থাকে। এলিটদের স্বার্থ, শাসক বা জনসাধারণ কারও স্বার্থের অনুকূল নয়। এরা রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থায়িত্বের ঘোর দুশমন। কাজেই সুশৃঙ্খল সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এদেরকে সমূলে বিনাশ করা প্রয়োজন।’
শক্তিশালী সেনাবাহিনী কেন দরকার?
প্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যদের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহারের কৌশলগুলোর ওপর বিস্তারিত বর্ণনা করে ম্যাকিয়াভেলি বলেন, ‘একটা সফল সরকারের অবশ্যই একটা শক্তিশালী সামরিক বাহিনী থাকা দরকার। দেশের প্রতিটা নাগরিককে অপর নাগরিকের হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর।’ তার মতে, ‘সে রাষ্ট্রই সফল, যার নাগরিকরা মনে-প্রাণে বিশ^াস করেন যে, তাদের নেতা তাদের প্রতি কোনো অন্যায় হতে দেবেন না। দিন শেষে নেতা সামরিক বাহিনী দিয়ে হলেও অন্যায় ঠেকাবেন। কিংবা হলেও তারা তার সঠিক বিচার পাবেন।’ ম্যাকিয়াভেলি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও এক রকম যুদ্ধশাস্ত্রের সঙ্গেই তুলনা করেছেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে শৃঙ্খলা বিদ্যমান, তা-ই তিনি রাজনীতিতে আনয়ন করতে বলেন। তিনি মনে করেন, ‘রাজনীতির অধিকাংশ দিকই হচ্ছে ষড়যন্ত্রমূলক। যা সামরিক কায়দায় সর্বোচ্চ গোপনীয়তা এবং প্রস্তুতির সঙ্গে সমাধান করতে হয়।’ ম্যাকিয়াভেলি শুধু রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক উপায়ে সমাধান করেই দমে যাননি। তিনি রাজনৈতিক আর সামরিক নেতার মধ্যে সাদৃশ্যও দেখিয়েছেন। ‘একজন সামরিক নেতা যেভাবে তার সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দেন, শৃঙ্খলিত করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ পরিচালনায় সৃজনশীল কাজ করেন। একজন রাজনৈতিক নেতাও একইরূপে দেশ পরিচালনা করেন। অন্যদিকে, একটা দেশের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হয় দুটো উপায়েÑ কূটনীতি, না হয় যুদ্ধ।’ ম্যাকিয়াভেলির মতে, ‘কূটনৈতিক সক্ষমতা যত বেশিই হোক না কেন। যুদ্ধ আবশ্যক এবং অনিবার্য। কারণ মানুষের অন্তর্নিহিত প্রকৃতিতে রয়েছে দ্বন্দ্ব, সহিংসতা ও যুদ্ধ। যুদ্ধের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা বহিঃরাজনীতি বলে আলাদা কোনো কথা নেই। এই যুদ্ধ আসতেই পারে।’ সেক্ষেত্রে তার গোপন পরামর্শ হচ্ছেÑ ‘যখন অবস্থা শান্তিপূর্ণ, তখনই একটা শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করে রাখতে হবে। কারণ, আজ অথবা কাল, যুদ্ধ আসবেই।’
বিলিয়ন ডলারের পরামর্শ
এরপর বর্তমান সময়ের বিলিয়ন ডলার মূল্যের খুব জরুরি একটা কথা রয়েছে বইতে। কথাটা হলো, ‘ধর্মভীরু ও ধর্মবিশ^াসের ভাবটা শাসককে বজায় রাখতেই হবে।’ পরক্ষণেই আবার বলা হয়েছে ‘যতই ধর্ম-ধর্ম কর না কেন। শাসককে মনে রাখতেই হবে, যে ব্যক্তি ভালোবাসে, ভালোবাসা চায় মানুষের, তার ক্ষতি করতে মানুষ কম ভয় পায়। আর যে ব্যক্তি অর্জন করতে পারে বা চায় মানুষের ভীতি, তার ক্ষতি করতে মানুষ অনেক বেশি ভয় পায়। শাসক ও নেতাকে, তুখোড় রাজনীতিককে, মানুষের ভালোবাসার থেকে বেশি অর্জন করতে হবে মানুষের ভয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রকে সবসময় যে ধর্ম ও নৈতিকতার পথ ধরে চলতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই।’ তিনি মনে করেন, ‘ধর্ম ও নৈতিকতার পথ অনুসরণ করে রাষ্ট্র যদি তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে তবে তা হবে সর্বাপেক্ষা উত্তম। তবে যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ প্রকৃতিগতভাবে মিথ্যুক, লোভী, হিংসুটে, দুর্নীতি পরায়ণ ও প্রতারক। কাজেই এ পথে চলে রাষ্ট্র কোনো দিনই তার উন্নয়ন উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বাধাপ্রাপ্ত হতে হবে। সুতরাং ধর্ম বা নৈতিকতার কথা আদৌ চিন্তা না করে রাষ্ট্র তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যা কিছু অনুকূলে তাই করে যাবে।’ তার মতে, ‘রাষ্ট্র যদি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারে, মাধ্যম যতই নীচ বা ঘৃণ্য হোক না কেন, অর্জিত সাফল্যই মাধ্যমের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে।’ তার বিশ^াস, ‘লক্ষ্য মাধ্যমের যৌক্তিকতা বিধান করে, মাধ্যম লক্ষ্যের নয়।’
আধুনিক রাষ্ট্রের প্রকৌশল বিদ্যা
গোটা বিশে^র বর্তমান রাজনীতি ‘দ্য প্রিন্স’ দ্বারা প্রভাবিত। বইটাকে বলা হয় আধুনিক রাজনীতির প্রকৌশলবিদ্যা। এই বইয়ের চেতনা ধারণের মাধ্যমে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কালের উন্নয়নমুখী, কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের সূচনা হয়েছে। ইউরোপের বর্তমান যে উন্নয়ন, তার পুরোটা এই বইয়ের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত। এ জন্য ইউরোপিয়ানরা সুশাসিত ও উন্নত। ওসব দেশের জনগণ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, সহিংসতা আপন মনে এড়িয়ে চলে। কেউ বেশি গরিবও নয়, আবার কেউ মাত্রাতিরিক্ত ধনীও নয়। করোনাকালে তারা আপন মনেই মাস্ক ব্যবহার করে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে। লকডাউনে নিয়ম মেনে ঘরে থাকে। ওসব দেশে করোনা চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষ প্রতারিত হয় না। রাষ্ট্র যদি নাগরিককে কাজ দিতে না পারে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেয়। কোথাও কোনোরূপ ভিক্ষুক নেই। চুরি চামারি তো নেই-ই। রাস্তাঘাটে মানুষ চলে একদম আইনের কালো অক্ষরের লাইন মেনে। অফিস-আদালতে কোথাও কোনো ঘুষ বাণিজ্য নেই। টেন্ডার বাণিজ্য তো নেই-ই। সরকারি বড় কর্তা, রাজনৈতিক নেতা কেউই দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয় না। রাষ্ট্র ক্ষমতার ভাগ দাবি করে মোল্লা, পুরোহিত ও যাজকরা খবরদারি, ধমক-ধামক দেয় না। সহিংসতার তাণ্ডব চালায় না। মানুষের দাবি আদায়ের জন্য হরতাল-ধর্মঘট করতে হয় না। নাগরিকের মৌলিক সমস্যার সব সমাধান সবসময় রাষ্ট্র দিয়ে থাকে।
আজকের সময়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটা শক্তিশালী, নতুন বাংলাদেশ যদি ধারাবাহিক উন্নয়নে কাজ করতে পারে, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, একদিন দেশে সহিংসতা, তাণ্ডব আর থাকবে না। সাধারণ মানুষ অ্যারিস্টটলের গণতন্ত্র এমনকি চীনের গ্রেট লিডার মাও সেতুংয়ের সমাজতন্ত্রের কথা ভুলে গিয়ে সুনাগরিক হয়ে উঠবে। মানুষ হয়ে উঠবে সুশাসিত উন্নত রাষ্ট্রের সেবক।

ষ বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
    সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
    ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়











সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close