ই-পেপার শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

মন শুধু মন ছুঁয়েছে
প্রকাশ: শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১, ৯:০১ এএম আপডেট: ১১.০৬.২০২১ ৯:১৬ এএম  (ভিজিট : ২২৪)
তিথি একটু পর পর দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির কাঁটার দিকে ব্যাকুল হয়ে তাকাচ্ছে। বিকেলের এই ক্ষণে তিথির সময় যেন আটকে যায়। ঘড়ির কাঁটা চারটা থেকে কোনোভাবেই পাঁচটার কাঁটায় পৌঁছতে চায় না। 

সপ্তাহের শনি, সোম, বুধ- তিনদিনের এই বিকেলগুলোতে তিথির মাঝে প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করে। এই অস্থিরতা তিথির পোষা বিড়ালটা টের পায়, টের পায় তার বারান্দার অতি যত্নে বেড়ে ওঠা মাধবীলতার গাছগুলো, এমনকি রোজ বিকেলে তিথিদের পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে যে পাখিটা মিষ্টি সুরে ডেকে ওঠে সে-ও তিথির এই অস্থিরতা টের পায়। টের পায় না শুধু তিথির বাড়ির লোকজন। এই ক্ষেত্রে অবশ্য তিথির বাড়ির লোকজনকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। তিথিদের এত বড় বাড়িতে গুনে গুনে মাত্র চারজন মানুষ। তিথি নিজে, তার বাবা, মা আর স্থায়ী একজন কাজের বুয়া। তিথির অবশ্য বড় বোন আছে। মাস চারেক আগে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে এখন তার বরের সাথে কানাডায় থাকে। বিকেলের এই সময়টায় বাবা-মা যে যার অফিসে থাকেন। কাজের বুয়াটাও দুপুরের সব কাজ সেরে লম্বা একটা ঘুম দেয়। তাই এই সময় তিথি একাকী থাকে নিজেকে ঘিরে, নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা তীব্র এই অস্থিরতা আর আবেগটাকে ঘিরে।

কলিং বেলের শব্দ হলো। কলিং বেলের শব্দ কানে যাওয়া মাত্রই তিথি তড়িঘড়ি করে অজু করতে ঢুকলো। গত চার মাস ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। কলিং বেল টুং টুং করে বেজে ওঠে। তিথি শব্দ পেয়ে ওয়াশরুমে ওজু করতে ঢোকে, এর মাঝে মারুফ আবদুল্লাহ্, যিনি তিথিকে গত চার মাস থেকে আরবি পড়াচ্ছেন তিনি ড্রয়িং রুমের ডিভানে এসে বসেন। তিথির অজু করার ফাঁকে কাজের বুয়া, মারুফ আবদুল্লাহ্র হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত দেয়। তিনি শান্তভাবে লেবুর শরবত শেষ করেন। তারপর ছাত্রীকে দেড় ঘণ্টা কোরআন শিক্ষা দেন। এই দেড় ঘণ্টা ছাত্রী এবং শিক্ষক দুজনেরই কাটে খুব অদ্ভুত নিয়মে। শিক্ষক পুরোটা সময় মাথা নিচু করে থাকেন, তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেন কোনোভাবেই ছাত্রীর চোখে যেন তার চোখ না পড়ে, আবার ছাত্রীও নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা অনিয়ন্ত্রিত এই আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিজের সাথে নিজে প্রাণপণ লড়াই করতে থাকে। তিথি ক্রমাগত ঘামতে থাকে। প্রতিদিনই ভাবে তার শিক্ষককে বলবে তিনি যেন আগামী দিন থেকে তাকে আর পড়াতে না আসেন। কোরআন শিক্ষার তার আর প্রয়োজন নেই। সে এখন একাই বেশ ভালোভাবে কোরআন তেলাওয়াত করতে পারে। তবে প্রতিদিনই তিথি নিজের মত পাল্টায়। ভাবে আরেকটা দিন যাক। সামনের দিন সে অবশ্যই উনাকে আসতে নিষেধ করে দেবে। তারপর আবার পরের দিন আসে। তিথি আবার মত পরিবর্তন করে। যদিও সে খুব ভালোমতো জানে, যার বাবা-মা দুজনেই সরকারি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের কাছে সামান্য একজন আরবি শিক্ষকের জন্য নিজের মেয়ের এই অস্থিরতার কোনো মূল্য নেই। তা ছাড়া তিথির বড় বোনের বিয়ে হয়েছে বিসিএস ফরেন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার সাথে। তাই তাদের ছোট মেয়ের ভাগ্যেও এমন পাত্র জুটুক বাবা-মা এমন চাইবেন এটাই স্বাভাবিক।
- তিথি।
তিথি ভীষণ চমকে গেল। গত চার মাসের মাঝে এমন ঘটনা প্রথম ঘটলো। মারুফ আবদুল্লাহ্ আজ প্রথম ছাত্রীর নাম ডেকে তাকে সম্বোধন করলেন। এতদিন কথাবার্তা আপনির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিথি প্রায় ভেবেই নিয়েছিল, তার আরবি শিক্ষকটি বোধহয় আদৌ তার নিজের ছাত্রীর নাম জানেন না।
তিথি মৃদু গলায় বলল, জি বলুন।
- আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। কথাগুলো কি এখন বলব? আপনার সময় হবে? নাকি অন্য আরেকদিন?
তিথি মাথা নেড়ে সায় দিল। মুখে বলল, আজই বলুন।
মারুফ আবদুল্লাহ্ নিজের গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, প্রথমে আপনাকে আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই।
- আপনার পরিচয় আমি জানি।
- আমার পুরো পরিচয় আপনি জানেন না।
তিথি এবার অবাক হয়ে মারুফ আবদুল্লাহ্র দিকে তাকালো।
- এতদিন আপনার কাছে আমার পরিচয় গোপন রেখেছি। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তারপর মারুফ আবদুল্লাহ্ হড়বড় করে বললেন, তৃণা আপু মানে আপনার বড় বোনের বিয়ের সময় একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা আপনাকে বিয়েতে দেখেন এবং নিজের ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে আপনাকে মনোনীত করেন। আপনার বাবা-মার কাছে তাদের ছোট মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পৌঁছাতে ভদ্রমহিলার একদিনও দেরি হয়নি। তৃণা আপুর বিয়ের রাতেই আপনার বাবা-মার কাছে আপনার বিয়ের প্রস্তাব পৌঁছে যায়। আপনার বাবা-মারও ছেলেকে অপছন্দ করার কোনো কারণ ছিল না। ছেলে গত বছর বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। এই বছরের শেষে একটা স্কলারশিপ নিয়ে ছেলেটি কানাডায় পার্মানেন্টলি সেটেল্ড হতে যাচ্ছে। এদিকে আপনিও অনার্স পরীক্ষা দিয়ে বসে আছেন। সবকিছু একেবারে দুই পরিবারেরই মনমতো মিলে গেল বলতে পারেন। আপনার বাবা-মাও বিয়ের এই প্রস্তাবে একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু বাদ সাধলো ছেলে নিজে। সে বিয়েতে রাজি হবার আগে মেয়েটির সাথে কিছুটা সময় নিভৃতে কাটাতে চাইলো। ছেলেটির এই সিদ্ধান্তের জন্য ছেলেটিকে অবশ্য খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। ছেলেটি সম্পর্কে আরেকটু জানলে ছেলেটির এমন ইচ্ছের কারণ আপনার কাছে স্পষ্ট হবে। সেই সময় মেয়েটির বাবা-মাও ছেলেটিকে বেশ ভালো একটা সাপোর্ট দিয়েছিল। মেয়েটির বাবা-মার পরামর্শেই ছেলেটি গত চার মাস থেকে মেয়েটিকে আরবি শিক্ষা দিয়ে আসছে। এখন আমি একটু ছেলের প্রসঙ্গে বলি। ছেলে বুয়েট থেকে পাস করেছে ঠিকই, কিন্তু তার জীবনদর্শন আজকালকার সাধারণ পাঁচ-সাতটা মুসলিম পরিবারের ছেলেদের মতো নয়। এই ছেলে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে কোনোদিন মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া বাদ দেয়নি। তার এমন কোনোদিন পার হয়নি যেদিন সে কুরআন তেলাওয়াত করেনি। সিগারেট কী জিনিস সে তা জানে না, শাহরুখ খান, আমির খান কে, সে তাদের চেনে না। তার নিজের কোনো মেয়ে বান্ধবী নেই, কোনোদিন ছিলও না। এমন নয় যে মেয়েদের পড়াশোনা করা, বাইরে চাকরি করা এসব নিয়ে তার কোনো আপত্তি আছে। কিন্তু তার নিজস্ব কিছু জীবনদর্শন আছে, দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যেটা সে কোনোভাবেই কারও ওপর চাপিয়ে দিতে চায় না। কারণ ইসলাম শান্তির ধর্ম, এখানে জোরজবরদস্তির কোনো জায়গা নেই। কথাগুলো এক নিশ^^াসে বলে মারুফ আব্দুল্লাহ্ তিথির কাছে একগ্লাস পানি চাইলো।
তিথি পানি নিয়ে এসে নতমুখে বলল, ছেলেটি এখন কী চায়? ছেলেটি আজ মেয়েটিকে এসব বলছে কেন?
- বলছে কারণ ছেলেটি তার মতো চিন্তাধারার একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী চায়। যে তাকে বুঝবে, তার বিষয়গুলো জানবে। সবকিছু জেনেশুনে তাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত হবে। তবে এইখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, ছেলেটি জোর করে মেয়েটির ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না। মেয়েটির পড়াশোনা, চাকরি সব ক্ষেত্রে মেয়েটির পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
তিথি লজ্জায় লাল হয়ে বলল, যদি স্বাধীনতা নাও-বা থাকত তাহলেও মেয়েটির কিছু করার ছিল না।
মারুফ আবদুল্লাহ্ অবাক হয়ে বলল, মানে?
তিথি আগের চেয়ে আরও মৃদু স্বরে বলল, মানে কি ছেলেটি এখনও বোঝেনি? ছেলেটি এত বোকা কেন?
তিথির কথা শুনে মারুফ আবদুল্লাহ্ লাজুক মুখে বলল, তাহলে কি ছেলেটি তার মাকে যেয়ে বলবে সবকিছু ঠিক আছে?
তিথি মুখ টিপে হেসে বলল, ছেলেটি যেন তার মাকে যেয়ে বলে, সবকিছু বড় বেশি ঠিক আছে।
আমাদের গল্পের পাত্র-পাত্রীকে কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। তাদের কথোপকথনের মাত্র সাত দিন পর ঘরোয়া পরিবেশে দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, বিয়ের আগে আমাদের গল্পের পাত্র মারুফ আবদুল্লাহ্কে বেশ সাদাসিধে আর লাজুক বলে মনে হলে কী হবে, বিয়ের পর তিথি কিন্তু ঠিকই টের পেয়েছে তার বরের মতো এমন দুষ্টু আর রোমান্টিক চরিত্রের পুরুষ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close