ফোনের গোঁ গোঁ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেয়াল ঘড়িতে ভোর ৪টা। এই সময়ে রবি? তড়িঘড়ি করে ফোন ধরতে রবি হড়বড় করে বলে, ‘পবন গাড়িটা নিয়ে আমার বাসায় আয় প্লিজ। তোর ভাবির পেইন উঠেছে। হাসপাতালে নিতে হবে।’ ‘ভাবির না সামনের মাসে ডেট বলেছিলি?’
‘হ্যাঁ। বুঝতে পারছি না কিছু। তুই আয়।’
‘আচ্ছা আসছি। দশ মিনিট লাগবে। টেনশন নিস না।’
ওর বাসা আমার বাসার দুই বাসা পর। ওদেরকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগল না। আমার পাশের সিটে রবি, পেছনে স্মৃতি ভাবির সঙ্গে রবির বোন মিতু। ভাবি যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমার স্টিয়ারিংয়ে রাখা হাত কাঁপছে। দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে ভাবিকে ইমার্জেন্সিতে নিলাম। সেখান থেকে বলা হলো এখনই অপারেশন করতে হবে।
সব ফরমালিটি সেরে আমি আর রবি ওটি থেকে সামান্য দূরে দুটো চেয়ার দখল করে বসে থাকি। মিতু ওটির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রবি হেলান দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পবন কাশবনের সেই ঘটনাটা তোর মনে আছে?’
আমি জানি কোন ঘটনার কথা বলছে। এ নিয়ে অসংখ্যবার ও এই আলাপ করেছে। প্রতিবার এই প্রসঙ্গ এলে ধীরে ধীরে অসংলগ্ন আচরণ শুরু করে দেয় রবি। আজ এ মুহূর্তে বিষয়টা তুলতে চাচ্ছিলাম না বলে সংক্ষিপ্ত করে বলি, ‘আছে’।
‘কত অবুঝ ছিলাম তাই না?’
‘হুম। এখন ওই আলাপ থাকুক রবি।’
রবিকে থামতে বলি কিন্তু আমার কপালের দুই পাশ চিনচিন করতে থাকে। সত্যি কত অবুঝ ছিলাম। বয়সের কারণেই হয়তোবা।
শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে তখন। সম্ভবত নবমীর দিন। ঢাকের শব্দ পেয়ে কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম আমরা। আমি আর রবি। শঙ্খ নদীর তীর ঘেঁষে বিশাল কাশবন মুসলমান আর হিন্দুপাড়ার মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছে। কাশবনের ওপাশে পূজামণ্ডপ। দুর্গাপূজায় রঙবেরঙের পোশাকে প্রতিমা দেখতে খুব ভালো লাগত আমার। আর ঢাকের সঙ্গে ঢাকীর নাচ দেখে তো কতদিন নিজেই নাচতে শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু পুজো দেখার বিষয়ে বাড়ি থেকে কড়া নিষেধ ছিল, সুতরাং খুব গোপনে যেতে হতো। পুরো কাশবন সেদিন সাদা কাশফুলে ছেয়ে ছিল। মানুষজন যাওয়া-আসার কারণে কাশবনের মধ্যে নানা দিকে সরু সরু কয়েকটা পথ তৈরি হয়ে গেছে। সেই পথের একটি ধরে আমরা দুজনে দৌড়াচ্ছি। রবি আমার থেকে বেশ কিছুটা সামনে ছিল। কিন্তু কেন জানি না হঠাৎ করে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে গেল। আমি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম। বামদিকের পথটির মুখে দুটো চোখে আমার চোখ আটকে গেছে। মানুষটির মুখ দেখার আগে চোখে কেন চোখ পড়েছিল সেটা আমি মনে করতে পারছি না। সম্ভবত তার মুখের তুলনায় চোখদুটো অত্যধিক বড় আর অস্বাভাবিক ছিল বলেই। তবে এটা খুব মনে আছে তাকে দেখার পর আমিও রবির মতো চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। দুটো উঁচু হাড়ের গভীরে বলতে গেলে কূপের মধ্যে ভেসে থাকা ওর ভয়াবহ দৃশ্য চোখ দুটো আমাদেরকে গিলে খাচ্ছিল।
আমি ধীরে ধীরে তার পুরো অবয়ব দেখি। সে মহিলা নাকি মেয়ে আমার সেই বয়সে আন্দাজ করা কঠিন। কিন্তু তার মুখটা হাঁ করা ছিল আর সে হাঁ মুখ থেকে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল। আমাদের সঙ্গে তার দূরত্ব মাত্র দুহাত। মহিলাটি সামনের দিকে দু-পা মেলে পেছনে দুটো হাতের ওপর পুরো শরীরের ভর দিয়ে বসে ছিল। শরীরের ওপর ময়লা পাতলা কালো ডুরের একটা শাড়ি প্যাঁচানো। শাড়িটির অজস্র জায়গায় ছেঁড়া। সেই ছেঁড়া একটা জায়গা দিয়ে বাম পাশের স্তনটি বেরিয়ে আছে। তখনও নারীশরীর সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞানই নেই। কিন্তু মহিলাটির বুকের দিকে তাকিয়ে আমার শরীরে অদ্ভুত এক ধরনের পরিবর্তন খেয়াল করলাম। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আবার প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু সব থেকে ভয়ঙ্কর লাগছিল তার পেট। দুটো শুকনো টিনটিনে পায়ের উপরাংশে বিশাল সাইজের পেটের ওপর কোনো কাপড় নেই। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পেটটা কাঁপছে। ভয়ে-আতঙ্কে আমি জমে মনে হলো পাথর হয়ে গিয়েছি। রবিকে ডাকব কিন্তু জিহ্বা, স্বর কোনোকিছুই আমার বাগে নেই। রবিরও হয়তো একই অবস্থা।
মহিলাটির গাল বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। একসময় হাঁপাতে হাঁপাতে কুঁকড়ে যেতে থাকে। মুখ দিয়ে জান্তব শব্দ বের হচ্ছে। কিন্তু তার গোঙানি থেকে অর্থবোধক একটা শব্দ আমরা উদ্ধার করতে পারলাম না। আমার মনে হলো এ কোনো মানুষ নয়, নিশ্চয় ডাইনি দুপুরবেলা কাশবনের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে এসেছে। এখনই হয়তো আমাদেরকে গিলে ফেলবে। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত কিন্তু পা তো নাড়াতেই পারছি না। মহিলাটি চিৎকার করতে করতে একসময় শুয়ে পড়ল। হঠাৎ কি হলো, তীব্র গোঙানির সঙ্গে সঙ্গে ওর দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঘোলাটে আর লালচে পানিভর্তি বলের মতো কিছু একটা আমাদের পায়ের কাছে এসে ছিটকে পড়ল।
আসলে সেটি বল নয়, অবিকল মানুষের মতো দেখতে ছোট্ট একটি শিশু। ওর হাত পা নাক চোখ মুখ সবই রয়েছে। মহিলাটির পায়ের কাছে রক্তের স্রোত। তার গোঙানি থেমে গেছে। চার হাত-পা ছড়িয়ে সে নিঃশব্দে নিশ্চল শুয়ে আছে। শিশুটি ক্ষীণ স্বরে ওঁয়াও ওঁয়াও করে কাঁদছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি থরথর করে কাঁপছি। আচমকা রবি আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দেয়, ‘চল চল এখান থেকে পালাই। ডাইনির বাচ্চা হইছে আমাদের খেয়ে ফেলবে।’
আমরা ঊর্ধ্বশ^াসে বাড়ির দিকে দৌড় শুরু করি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল শিশুটির কান্না সমস্ত কাশবনে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদেরকে ধাওয়া করে আসছে।
ওটির লাল বাতি নিভে গেছে। দরোজা একটু ফাঁক হলো। সদ্যোজাত শিশুর কান্না ঘোষণা দিল সে দুনিয়ায় এসে গেছে। আমি রবির হাতটা নিজের হাতে মুঠো করে বলি,
‘কংগ্রেচুলেশনস তুই তো বাপ হয়ে গেলি বেটা।’
রবি উদাস হয়ে বলে, ‘হুম।’
‘কী চাস? ছেলে না মেয়ে?’
‘জানি না। ওই বাচ্চাটা কি ছিলেরে?’
‘সে তো মনে নেই। ওই বাচ্চার কথা রাখ তো।’
‘আচ্ছা পবন, বাচ্চাটাকে কি শিয়ালে খেয়েছিল? মাথাটা খায়নি কেন?’
‘উফ রবি, আজকের দিনে এসব কেন ভাবছিস?’
‘জানি না রে। আমাদের জন্যই বাচ্চাটা মরে গেল। ওর মা হয়তো বোবা পাগল ছিল, কী আর করতে পারত।’
‘আমাদের বয়স কত ছিল তখন? আর গিয়েছিলাম তো চুরি করে, বাড়িতে বললে মাইর খেতে হতো না?’
‘তবু জানানোর দরকার ছিলরে।’
‘আমরা সেদিন বাড়িতে কাউকে জানাইনি। তখন সেটিই সঠিক মনে হয়েছিল। আমি আর রবি পরের দিন আবার কাশবনে গিয়েছিলাম। ঘাসের ওপর জমাট রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে ছিল। একপাশে ছোট্ট একটা মাথা। চোখ-মুখের জায়গায় গর্ত গর্ত। মাথাভর্তি চুল। আমরা আগের দিনের মতোই দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর থেকে রবি একটা ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত সেই ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি। সদ্যোজাত কোনো শিশু দেখলে ও কেমন জানি হয়ে যায়।
মিতু তোয়ালে করে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে এদিকেই নিয়ে আসছে। আমি এগিয়ে যাই কিন্তু রবি বসেই থাকে।
মিতু বাচ্চাটিকে নিয়ে রবির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ভাইয়া দেখো, ছেলে হয়েছে। ওর কানে আজান দাও।’
রবি তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর পেছাতে থাকে।
‘পবন, এ সেই বাচ্চাটা দেখ।’
‘ধুর পাগল, কী বলছিস এসব?’
‘সত্যি বলছি। দেখ চোখ-মুখ কিচ্ছু নেই সব শিয়ালে খেয়ে ফেলেছে।’
মিতু ভাইয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে বাচ্চাটি চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। রবি বলে, ‘পবন পালা, পালা পবন।’
রবি হাসপাতালের সুনসান লবি ধরে দৌড়াচ্ছে। আমি শিশুটির দিকে তাকাই। ওর মাথাভর্তি কেবল চুল।