দেশে কমতে শুরু করেছে করোনার প্রকোপ। প্রতিদিনই করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে। এর সঙ্গে সর্বত্র দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। সড়কপথে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। শপিংমল, বিপণিবিতান, দোকানপাটে ঢল নেমেছে ক্রেতাদের। সামাজিক দূরত্ব মানছে না কেউ। মুখ থেকে মাস্ক উধাও। পর্যটন এলাকাগুলোতে দেদার ঘুরে বেড়াচ্ছে অধিকাংশ মানুষ। পরোয়া নেই স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের। বাস, ট্রেনসহ গণপরিবহনে গাদাগাদি করে যাত্রীরা চলাচল করছে। করোনার সংক্রমণের এ সময়ে স্বাস্থ্যবিধির এমন করুণ দশা দেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, সামনে ভয়াবহ বিপদ আসছে।
তারা বলছেন, দেশে করোনা পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমার এ প্রবণতা ধরে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। এর আগেও করোনার সংক্রমণ কমে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেদের ভুলে টানা সাড়ে ৫ মাস করোনার ভয়াবহকাল পার করে বাংলাদেশ। অক্টোবরে প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশেই করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় ঢেউ থেকে দেশকে নিরাপদে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারের কঠোর হওয়ার বিষয়ে তারা পরামর্শ দেন।
আগে রাজধানীর মার্কেট বা শপিংমলের সামনে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও এখন তা নেই। কোনো তদারকিও নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইবাদত করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। মুসল্লিদের মুখে মাস্ক নেই। পরিচ্ছন্নতায় আগের মতো জোর নেই। ওয়াক্তের নামাজে তিন ফুট দূরত্বের বালাই নেই। মসজিদের ভেতরে যেমন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মুসল্লিরা নামাজ পড়ছে, তেমনি শুক্রবার জুমার নামাজে মসজিদ ছাপিয়ে সড়ক বা রাস্তায় কাতারে দাঁড়াচ্ছে মুসল্লিরা।
হাসপাতালে রোগীর স্বজনরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালেও রোগীর স্বজনদের মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। জীবিকার জন্য মানুষকে ঘরের বাইরে বের হতে হবে। একই সঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরতে চরম অনীহা দেখা যাচ্ছে। এজন্য করোনার সংক্রমণে আবারও বেসামাল হয়ে যেতে পারে দেশ। এভাবে চলতে থাকলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আবার ভেঙে পড়বে, যা গত ৬ মাসে দেখা গেছে। হাসপাতালে জায়গা হয়নি। রোগী নিয়ে স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটেছে। সে সময় তীব্র ছোঁয়াচে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের (ডেল্টা) প্রকোপে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভয়াবহ সব রেকর্ড দেখেছে বাংলাদেশ।
এদিকে বুধবার করোনায় আরও ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে ১ হাজার ৩৭৬ জনের দেহে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আগের দিন মঙ্গলবার সাড়ে ৬ মাস পর রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নামে। পরীক্ষার বিপরীতে সেদিন রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। শনাক্তের হার এর চেয়ে কম ছিল গত ৭ মার্চ, ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। করোনায় মাঝারি থেকে স্বল্পঝুঁকিতে নামে বাংলাদেশ।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। মহামারি শুরুর পর থেকে সব মিলিয়ে দেশে ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ১৭৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার ৩১৩ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে ১ হাজার ৪২৭ জন সুস্থ হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে দেশে করোনাজয়ীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬ হাজার ১৩৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এরপরই চট্টগ্রাম বিভাগে ১০ জন মারা গেছে।
রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট বিভাগে ২ জন করে এবং রংপুর ও ময়মনসিংহে একজন করে মারা গেছে। বরিশাল বিভাগে একজনও মারা যায়নি। ঢাকা বিভাগেই নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯৪৮ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহে ১৯, রাজশাহীতে ৭৭, খুলনায় ৬০, রংপুরে ৪৪, বরিশালে ১৪, সিলেটে ৩৯ জনের শনাক্ত হয়েছে ২৪ ঘণ্টায়।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান সময়ের আলোকে বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন অভ্যাসে পরিণত করতে পারিনি। স্বাস্থ্যবিধি অভ্যাসে পরিণত না করতে পারলে করোনা পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ হবে। সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, ভিড় এড়িয়ে চলা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, মাস্ক পরা, সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার বিষয়গুলোকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, করোনা থেকে নিজেকে সুরক্ষা দিতে যেসব বিষয় জরুরি তা মানতে অনীহা দেখা যাচ্ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারছি না। চাপিয়ে দিয়ে বা জোর করে কিছু করানো সহজ নয়। করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
সময়ের আলো// এসএ