ই-পেপার শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

ইলিশ : জলের উজ্জ্বল শস্য
প্রকাশ: শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১, ৭:২৯ এএম  (ভিজিট : ২৩৬৫)
ঈশ্বরী পাটুনী অন্নপূর্ণার কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। কিন্তু বাঙালি হয়ে উঠেছে মাছে-ভাতে বাঙালি। জানি না কোন বাক্যটি প্রাচীন, কোনটি অর্বাচীন। তবে ভোজনরসিক বাঙালিকে যদি বলা হয়, নদীমাতৃক এই দেশে নানা পদের মাছের মধ্য থেকে কোনটি তার প্রিয়? দ্বিধাহীন চিত্তেই বলা যায়, উত্তর হবে ইলিশ। প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকে ইলিশকে সব মাছের সেরা বলা হয়েছে। যদিও অনেক শাস্ত্রকার ইলিশকে বাদ দিয়ে রোহিত মৎস্য অর্থাৎ রুই মাছকেই মাছেদের মধ্যে সেরা বলেছেন। যা হোক সে ভিন্ন আলাপ। আমরা ইলিশের কথা বলি। সর্বানন্দের ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থে ‘ইল্লিষ’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কাশীর গঙ্গায় ইলিশ পাওয়ার কথা বলেছেন। এই সুযোগে বলে নিই, বেহুলা-লখিন্দরের বিয়েতে বেহুলার বাবা পাত্রপক্ষকে যা যা দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল, তার মধ্যে ১৮ পদের মাছের মধ্যে ভাজা ইলিশও ছিল। আহা! ভাজা ইলিশ। ভাজা ইলিশের কথা উঠলে বাঙালির রসনা রসসিক্ত হবে না, এমন বাঙালি কমই পাওয়া যাবে।

ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের পরই পাই যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বর গুপ্তকে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় মাছের কথা এলেও, তোপসে মাছ নিয়ে তিনি কবিতা লিখলেও ইলিশ নিয়ে কোনো কবিতা লিখেননি। ইলিশ নিয়ে কবিতা লিখেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ। তবে আধুনিক কবিদের মধ্যে ইলিশ নিয়ে একটি চমৎকার কবিতা পাই বুদ্ধদেব বসুর কাছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো ইলিশকে কবিতার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। কেননা, ‘কুক্কুট’ নিয়ে কবিতা লেখা যায়, এটা তিনি মানতেন না। পরে তার সঙ্গে অনেকটা বাজি ধরেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘কুক্কুট’ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। (হায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্তও ইলিশ নিয়ে কবিতা রচনা করেননি।) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইলিশ নিয়ে পঙ্ক্তি রচনা না করলেও তার জীবনীতে ইলিশের সঙ্গে তার সাক্ষাতের সন্ধান আমরা পাই। রবীন্দ্রনাথ প্রচুর পরিমাণে ইলিশ কিনে সেগুলো পচিয়ে কীভাবে জৈবসার তৈরি করা যায়, তা তার প্রজাদের শিখিয়ে ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামও ইলিশ নিয়ে কোনো কবিতা রচনা করতে আগ্রহী হয়ে উঠেননি। তবে ইলিশের গুণাগুণ সম্পর্কে তিনি যে ওয়াকিবহাল ছিলেন, তা বলতে পারি। জুলফিকার হায়দার ‘স্মৃতি-রঙ্গ’ নামক গদ্যে তেমনি এক চিত্র তুলে ধরেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম গিয়েছেন সিরাজগঞ্জে নিখিলবঙ্গ মুসলিম যুব সম্মেলনে। এক দিন সবাই খেতে বসেছেন। আসাদউদ্দৌলা সাহেব ও গিয়াসউদ্দীন সাহেব পরিবেশন করছেন। তারা সবার পাতে ইলিশভাজা দিয়ে চলেছেন। কবি দেখতে দেখতে বড় দুই টুকরো ভাজামাছ খেয়ে ফেলেছেন। এমন সময় একজন পরিবেশক এসে নজরুলের থালায় আরও ভাজামাছ দিতে যাচ্ছিলেন। নজরুল বাধা দিলেন। বললেন, ‘আরে করছ কী? শেষকালে আমাকে বিড়ালে কামড়াবে যে!’

অনেকেই কবি সাহেবের কথা বুঝতে পারলেন না। গিয়াসউদ্দীন সাহেব তখন বললেন, ‘মানে!’

কবি হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘ও বুঝতে পারছেন না! ইল্শে মাছ- যে মাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরায়, বিড়ালকে মাতাল করে তোলে। বেশি খেলে কি আর রক্ষে আছে!’
সবাই হেসে উঠল।
কিছু আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ইলিশ নিয়ে কবিতা না লিখলেও বুদ্ধদেব বসু একটি চমৎকার কবিতা লিখেছেন। ইলিশ মাছ ধরার বর্ণনাও উঠে এসেছে সেখানে। ইলিশকে বলেছেন, ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’।

কবিতার কয়েকটি লাইন-
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
(ইলিশ)

বুদ্ধদেব বসুর কিশোর কবিতা ‘নদীর স্বপ্নে’ও ইলিশ মাছের কথা এসেছে। কবিতায় বড় ভাই ছোট বোন ছোকানুকে নিয়ে নৌকায় করে কিছুক্ষণ ঘুড়ে বেড়াবে। সেই সময় তারা কী কী দেখবে, কী কী করবে, সেই বর্ণনাতেই ইলিশের প্রসঙ্গ এসেছে। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন-
‘ওটা কী? জেলের নৌকা? তাই তো!
জাল টেনে তোলা দায়,
রূপোলি নদীর রূপোলি ইলিশ-
ইশ, চোখে ঝলসায়!
ইলিশ কিনলে?- আঃ, বেশ, বেশ,
তুমি খুব ভালো, মাঝি।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক
রান্নার কারসাজি।
পইঠায় বসে ধোঁয়া-ওঠা ভাত,
টাটকা ইলিশ-ভাজা-
ছোকানু রে, তুই আকাশের রানী,
আমি পদ্মার রাজা।’

বুদ্ধদেব বসু পূর্ব বাংলা ছেড়ে কলকতায় চলে গিয়েছিলেন ঠিকই, তবে পূর্ব বাংলার অনেক স্মৃতিই তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। ইলিশ তার একটি।
ইলিশ মাছ ধরার একটি বিশ্বস্ত চিত্র পাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে। উপন্যাস শুরুই করেছেন ইলিশ মাছ ধরার বর্ণনা দিয়ে। লিখেছেন,
‘বর্ষার মাঝামাঝি। পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে- নৌকার আলো ওগুলি। সমস্ত রাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় মøান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সংকেতের মতো সঞ্চালিত হয়। একসময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে গ্রামে রেল-স্টেশনে ও জাহাজঘাটে শ্রান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে-নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’

এরপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের নায়ক কুবেরের কথা বলেছেন। মাছ ধরার জালের বর্ণনা দিয়েছেন। জেলেদের মনস্তাত্ত্বিক চিত্রও তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। বেশি মাছ ধরা পড়তে দেখে খুশি হতে পারে না জেলেরা। কারণ সবার জালেই যদি বেশি বেশি ইলিশ ধরা পড়ে, তাহলে মাছের দর পড়ে যাবে। এ ছাড়া চুরি করে মাছ বিক্রি করার কথাও আমরা পাই। বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ইলিশ মাছের কথার পাশাপাশি আরেকটি দিক ফুটে উঠেছে, তা জেলেদের দারিদ্র্য-দুর্দশার চিত্র। দুঃখের বিষয় হলো জেলেদের এ দুরবস্থা এখনও কাটেনি। অন্যদিকে মাছের দামও আকাশছোঁয়া। আসলে ক্রেতা এবং জেলের মাঝে আরেকটি পক্ষ আছে লাভের গুড় তাদের পেটেই যায়।

বাংলা প্রবাদপ্রবচনে ইলিশ মাছের কথা আছে। ছড়াতেও আমরা ইলিশ মাছের উল্লেখ পাই। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন-
‘ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম।
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।’
(ইলশে গুঁড়ি)

ইলিশ মাছের ঝোল বাঙালির কাছে অতি উপাদেয়। এই ঝোল কোনো বউ যদি ভালো করে রান্না করতে পারে, তাহলে সে-ই হয়ে ওঠে ‘সোনাবউ’। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছড়ায় তেমনি এক চিত্র পাই-
‘সোনা নাচে কোনা
বলদ বাজায় ঢোল
সোনার বউ রেঁধে রেখেছে
ইলিশ মাছের ঝোল।’

ইলিশ নানাভাবে বাংলা গল্প-কবিতায় এসেছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রমনাথ বিশী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীসহ অনেকেই তাদের লেখায় ইলিশের গুণগান গেয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তার মতে, বেহেশতের খাবারের বর্ণনায় যদি ইলিশের কথা উল্লেখ থাকত, তাহলে কেউই পাপ করে নরকে যেত না।

বাঙালির মুখে মুখে গোপাল ভাঁড়, নাসিরুদ্দীন হোজ্জার যে গল্প চালু আছে, সেখানেও ইলিশ মাছের উল্লেখ পাই। গল্প দুটো প্রচলিত। তাই এখানে উল্লেখ করলাম না। এর বদলে কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি ঘটনা বলে লেখাটি শেষ করছি।

তখন নির্মলেন্দু গুণ তরুণ। অন্য কবি বন্ধুদের নিয়ে রাতের ঢাকা শাসন করত। এক দিন গভীর রাতে তারা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় টহলরত পুলিশ এসে তাদের পাকড়াও করে। নির্মলেন্দু গুণ নিজেকে কবি বলে পরিচয় দেন। বলেন, আমি আপনাদের নিয়ে কবিতা লিখেছি আর আপনারাই আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশরা বোধহয় তার কথা প্রথমে বিশ্বাস করে না। তাই কবিতা শোনাতে বলে। তখন নির্মলেন্দু গুণ মুখে মুখে দুই লাইন পদ্য বানিয়ে শোনায়। বলে, মাছের রাজা ইলিশ/ মানুষের রাজা পুলিশ। বলা বাহুল্য কবি নির্মলেন্দু গুণ সেদিন ইলিশের সঙ্গে পুলিশের অন্ত্যমিল দিয়ে পদ্য বানিয়ে পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছিল।




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close