এখন প্রিন্ট মিডি
য়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও আইনপাড়া জুড়ে সব জায়গায় আলোচনার বিষয়বস্তু নাসির-তামিমার বিয়ে। নাসির-তামিমার বিয়ে বৈধ নাকি অবৈধ? কী হবে নাসির-তামিমার সর্বশেষ অবস্থান। তাদেরকে যদি আইনি প্রক্রিয়া ফেস করতে হয় তাহলে তাদের কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
আসলে মূল যে উপযুক্ত বিষয়, সেটা হচ্ছে নাসির-তামিমার বিষয়টি কি অবৈধ বিয়ে, বৈধ বিয়ে নাকি অনিয়মিত বিয়ে? আমরা বিষয়টির পটভূমি সবাই জানি। তারপরও আমি সবার জ্ঞাতার্থে বলছি, সেটি হচ্ছে নাসির এবং তামিমার বিয়ের আগে তামিমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে ছিল রাকিব নামে একটি ছেলের। তাদের একটি ৮ বছরের সন্তানও আছে। তারপর তামিমা বলছেন যে, যখন নাসিরের সঙ্গে পরিচয় হয়, পরিচয় হওয়ার আগে কিংবা পরিচয় হওয়ার পরে তামিমা রাকিবকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন এবং ডিভোর্স দেওয়ার পরে নাসিরকে বিয়ে করেছেন। অন্যদিকে পিবিআই যে রিপোর্ট দিয়েছে সেটি হচ্ছে, তামিমা যে বলছে নাসিরকে বিয়ে করার আগে সে রাকিবকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন সেই ডিভোর্সটি সঠিক আইনগত প্রক্রিয়ার করা হয়নি বা আদৌ দিয়েছিলেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
নাসির-তামিমার বিয়ে বৈধ নাকি অবৈধ? এ বিষয়টি আলোকপাত করার জন্য আমাদের মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী কী বলা হয়েছে, সেটা একটু দেখতে হবে। আসলে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে মুসলিম বিয়েকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে বৈধ বা নিয়মিত বিয়ে, একটি হচ্ছে অনিয়মিত বিয়ে এবং আরেকটি হচ্ছে অবৈধ বা বাতিল বিয়ে।
যে বিয়েতে আইনে নির্ধারিত সবগুলো শর্ত পূরণ করা হয়- তাই হচ্ছে বৈধ বিয়ে। আর বৈধ বিয়ের ফলে, ফলাফল হিসেবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহবাস ও সন্তান জন্মদান আইনস্বীকৃত হয়, একে অপরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় এবং স্ত্রী ও সন্তানেরা ভরণপোষণ-খোরপোশ পায়, স্ত্রীরা দেনমোহর পাওয়ার হকদার হয়।
অপর দিকে অনিয়মিত বিয়ে বলতে বোঝায়- যেখানে বৈধ বিয়ের কোনো না কোনো শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে, এই বিয়েকে ত্রুটিযুক্ত বলা হয় অর্থাৎ আইনগত কোনো বাধা এই বিয়েতে রয়েছে, এই বাধা সাময়িক হতে পারে আবার স্থায়ী হতে পারে। মনে রাখতে হবে এটা অবৈধ বিয়ে নয়। অনিয়মিত বিয়ের ক্ষেত্রে মুসলিম আইনে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বিশেষ কিছু বিবেচনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে, যেমন একজন পুরুষ সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। যদি কেউ চারের অধিক বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে একজনকে তালাক দিলে বা তাদের মধ্যে একজন মারা গেলে সর্বশেষ বিয়েটি নিয়মিত হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে চারটি বিয়ের পর যতসংখ্যক বিয়ে করা হোক না কেন তা বাতিল বা অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হবে না। সুতরাং ১৩ বা ১৪টি বিয়ের ক্ষেত্রে ৪ নম্বর বিয়ের পরের যে বিয়েগুলো কোনোটাই অবৈধ হবে না, পুরুষদের ক্ষেত্রে, কিন্তু অবশ্যই ৪-এর অধিক প্রত্যেকটি হবে অনিয়মিত বিয়ে।
এবার আসা যাক নারীদের ক্ষেত্রে মুসলিম শরিয়াহ আইন কী বলে। যদি কোনো স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান তাকে অবশ্যই প্রথম স্বামীর সঙ্গে যথাযথ আইন মেনে ডিভোর্স করে নিতে হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে, প্রথম স্বামীকে তালাকের নোটিস প্রদানপূর্বক ৯০ দিনের শেষে তালাক কার্যকর হয়। যদি কেউ প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় কোনো স্ত্রী যদি অন্য কাউকে বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে প্রথম স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন। দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সেইসঙ্গে জরিমানা হবে। তবে স্ত্রী যদি তার পূর্বের স্বামীর সাত বছর যাবৎ কোনো খোঁজখবর না পান, অথবা তিনি জীবিত থাকতে পারেন- এমন কোনো তথ্য যদি জানা না যায়, তাহলে পরবর্তী স্বামীকে সত্যি ঘটনা জানিয়ে তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। এটি দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারার বিধানের ব্যতিক্রম। আর এই ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রে স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে শাস্তিযোগ্য হবে না। অন্যদিকে স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় যাকে বিয়ে করছেন, তার কাছে পূর্বের বিয়ের কথা গোপন করেন, তাহলে সেটি দণ্ডবিধির ৪৯৫ ধারা অনুসারে একটি অপরাধ। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা। যদি তামিমা এক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারেন যে, রাকিবের সঙ্গে ডিভোর্সের পরেই তামিমা নাসিরকে বিয়ে করেছেন তাহলে তাদের বিয়ে অবৈধ নয়। তামিমা আদালতে যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি যথাযথভাবে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন তাহলে তাদের বিয়ে বৈধ আর যদি না পারেন তাহলে তাদের বিয়ে অবৈধ।
আর যদি তামিমা এবং নাসির প্রমাণ করতে না পারেন যে, তাদের বিয়েটি আসলে বৈধ তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় আসতে হবে এবং তাদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ; সেটি হচ্ছে তাকে যেকোনোভাবেই প্রমাণ করতে হবে যে তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার পরেই তিনি নাসিরকে বিয়ে করেছেন।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট