ই-পেপার শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ফেসবুক: যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ঘৃণা
প্রকাশ: সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১, ৮:৩০ এএম  (ভিজিট : ৪৩৭)
বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন দেশের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।

এ বছর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা ৯ অক্টোবর এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ফেসবুক গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ‘বিশ্বে সংবাদের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ফেসবুক। প্রতিষ্ঠানটির অ্যালগরিদম ভুয়া তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানো ঠেকানোকে অগ্রাধিকার দিতে সফল হয়নি। এমনকি তথ্য প্রকাশ ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে ফেসবুক। ফেসবুক গণতন্ত্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, এমন মন্তব্য করে মারিয়া রেসা বলেন, ‘আপনার কাছে যদি তথ্য না থাকে, তবে আপনি প্রকৃত সত্য জানতে ও বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবেন না। আর এসবের অভাব গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তোলে।

অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগের একটি সম্মেলনে ফেসবুকের প্রধান মার্ক জাকারবার্গের কঠোর সমালোচনা করে ব্রিটিশ কমেডিয়ান সাশা ব্যারন কোহেন বলেছিলেন, ১৯৩০-এর দশকে যদি ফেসবুক থাকত তাহলে তারা হিটলারকে তার ইহুদি বিদ্বেষী ধ্যান ধারণা প্রচারের একটি প্লাটফর্ম তৈরি করে দিত। ‘আলি জি’, ‘দ্য ডিক্টেটর’-এর মতো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের তারকা নিউইয়র্কে এক ভাষণে ফেসবুকের এমন সমালোচনা করেন।
২০১৯ অক্টোবরে এক সম্মেলনে বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ না করার একটি সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিলেন মার্ক জাকারবার্গ। ওই বক্তব্যের সমালোচনা করে অভিনেতা ব্যারন কোহেন বলেন, আপনি যদি তাদের টাকা দেন, তাহলে তারা যেকোনো রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালাবে, এমনকি সেটি যদি মিথ্যা হয় তবুও। এবং এই নীতি অনুসারে ফেসবুক যদি ১৯৩০-এর দশকে থাকত, তাহলে তারা হিটলারকেও ‘ইহুদি সমস্যার সমাধান’ বিষয়বস্তুতে ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দিত। ব্যারন কোহেন মন্তব্য করেন, সামাজিক মাধ্যম কীভাবে ঘৃণা, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা ছড়ায় তা বুঝে এর ব্যবহার সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে। আমার মনে হয় আমরা সবাই একটা বিষয়ে একমত হব যে, ধর্মান্ধ ও শিশু নির্যাতনকারীদের চিন্তাভাবনা প্রসারের উদ্দেশ্যে তাদেরকে বিনামূল্যে একটি প্লাটফর্ম দেওয়া মোটেই উচিত হবে না।’

এদিকে বাংলাদেশে এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত চলছে দেশের গুণী ব্যক্তিদের পোস্টে অশালীন মন্তব্য, সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার এবং গুজবের ছড়াছড়ি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গুজবের বলি হয়েছে অনেকে। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কিছুতেই ফেসবুকের অপব্যবহার ঠেকাতে পারছে না সরকার। ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানালে তারা কমিউনিটি স্ট্যান্ডারের দোহাই দিয়ে বারবার এড়িয়ে যায়।
গত এক বছরে ফেসবুকের কাছে ১৮ হাজার ৮৩৬ লিংক অপসারণের জন্য অনুরোধ জানায় বিটিআরসি। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ৮৮৮টি লিংক রিমুভ করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ইউটিউবকে ৪৩১টি লিংক অপসারণের অনুরোধ করলে তারা মাত্র ৬২টি লিংক অপসারণ করেন। এ বিষয়ে বরাবরের মতো নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানালেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ফেসবুকের জন্মস্থান আমেরিকায়। এটি তাদের নিয়মানুযায়ী চলে। নিয়ম অনুযায়ী ফেসবুকের কাছে রিপোর্ট করতে হয় এবং তারা যদি মনে করে এটি বন্ধ করা দরকার তারা সেটি বন্ধ করেন। আমরা এগুলো মনিটরিং করে ফেসবুক, ইউটিউবকে জানাতে পারি। আমাদের কিছু করার নেই।

পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতার ছবি পোস্ট করা যেসব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর রেকর্ড প্রকাশ করতে ফেসবুককে নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আদালত। ওয়াশিংটন ডিসির আদালতের একজন বিচারক এ সংক্রান্ত একটি রুল জারি করেছিলেন। রুলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য মিয়ানমারকে বিচারের মুখোমুখি করতে তদন্তকারীদের তথ্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ফেসবুকের সমালোচনা করেছেন বিচারক। এর আগে, ব্যবহারকারীর তথ্য প্রকাশ করাকে মার্কিন আইনের লঙ্ঘন উল্লেখ করে সেসব অ্যাকাউন্টের তথ্য সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল ফেসবুক। তবে ফেডারেল আদালতের বিচারক বলেন, মুছে ফেলা পোস্টগুলো প্রকাশ করা আইনের লঙ্ঘন হবে না বরং ওই কনটেন্টগুলো শেয়ার না করা হলে ‘রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডিকে আরও ঘনীভূত করবে’। এরপর ফেসবুকের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘তারা এর আগেই এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে মিয়ানমারের বিষয়ে জাতিসংঘের আরেকটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থার কাছে স্বেচ্ছায় ও আইনি প্রক্রিয়ায় তথ্য প্রকাশ করেছেন।

অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যার কোনো ছবি বিশেষ দিনগুলোতে ফেসবুকে পোস্ট দিলে সেটি প্রকাশ না করে কাভার করে দেওয়া হয়। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ঘটনা একই রকম তাহলে বাংলাদেশের প্রতি ফেসবুকের কেন এই পক্ষপাতমূলক আচরণ? প্রশ্ন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট লীনা পারভীন সময়ের আলোকে বলেন, ‘ফেসবুকের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যার ছবি পোস্ট দিলে সেটাকে স্ট্যান্ডার্ডের অজুহাতে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে, মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো লেখা দিলে সেখানে তারা স্ট্যান্ডার্ডের নীতি দেখাচ্ছেন, আইডি ব্যান করে দিচ্ছে। কিন্তু মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ এমনকি কাউকে সরাসরি মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার ভিডিও বা পোস্ট থেকে যাচ্ছে অনায়াসে। অভিযোগ করলে তারা বলে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভঙ্গ করেনি। আমার মনে হয় বাংলাদেশে তারা কোনো গোষ্ঠীর পারপাস সার্ভ করছে। মৌলবাদকে প্রমোট করছে।
 
তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে লুকানোর মতো কোনো বিষয় না। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে রোলপ্লে করছে। আমাদের মন্ত্রণালয়েরও দুর্বলতা রয়েছে। ফেসবুক ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান তাকে নিয়মের আওতায় আনা কঠিন কিছু না। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত তাদের নিয়ম মানাতে পারলে আমরা কেন পারব না? তারা আমাদের দেশে ব্যবসা করে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই তারা আমাদের কথা শুনতে বাধ্য। দ্রুত ফেসবুককে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।

প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা সময়ের আলোকে বলেন, ফেসবুক রোবট (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হয়। এটি পরিপক্ব না হওয়ায় তারা ধরতে পারছে না না কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ। আর আমাদের চুক্তি না থাকায় আমাদের রোবটের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে প্যানেল থাকলে আমরা নিজেরাই এটি ডিলিট করতে পারতাম। সাউথ এশিয়ান বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ফেসবুকের রাষ্ট্রীয় চুক্তি থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে নেই। ফেসবুককে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে এবং কূটনৈতিক তৎপরতা জরুরি বলে মনে করি। কথা বললেই যে কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এগুলো তো ফেসবুক দেখছে। তারা অ্যাডমিন প্যানেল দিচ্ছে না তাতেই এ অবস্থা। ফেসবুককে বোঝাতে হবে কথা বলার স্বাধীনতা কী? সরকারকে শিথিল হতে হবে। আমাদের দেশের সংস্কৃতি বোঝাতে হবে। 


আরও সংবাদ   বিষয়:  ফেসবুক   ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে  




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close