ই-পেপার শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

পিপিই-টেকনিক্যাল গার্মেন্টস খাত : ৯০ বিলিয়ন ডলারের বাজার অধরা
প্রকাশ: বুধবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২১, ১:০৩ পিএম আপডেট: ১৩.১০.২০২১ ১:০৮ পিএম  (ভিজিট : ৩৭০)
করোনা মহামারি কারণে অনেক ব্যবসা খাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর উল্টো দিকও আছে। করোনাকালে অনেক নতুন খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যেমন পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্টসহ (পিপিই) অনেক কোভিড সামগ্রীর বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজারে। যেমন ২০২৫ সাল নাগাদ পিপিইর বাজার হবে ৯০ বিলিয়ন ডলারের। এ ছাড়া টেকনিক্যাল গার্মেন্টস খাতের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। পিপিইসহ টেকনিক্যাল গার্মেন্টস খাতের ১৮০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে বিশ্বে। অথচ এই বিশাল বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ।

জার্মানভিত্তিক সংস্থা ‘গিজ’ (ডয়েচে গেজেলেশাফট ফুয়ের ইন্টারন্যাশিওনালে সুজামেনারবাইট-জিআইজেড)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অন স্কেলিং আপ দ্য প্রোডাকশন অব টেকনিক্যাল টেক্সটাইল (টিটি) ইনক্লুডিং পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ এখনও টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই পণ্যের বড় ক্রেতা ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার ধরার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।

মঙ্গলবার পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণাটি প্রকাশ করে জার্মানভিত্তিক এই সংস্থা। তবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, টেকনিক্যাল গার্মেন্টস খাতের বিশাল বাজার ধরতে না পারার পেছনে প্রধান কারণ কাঁচামালের অপ্রতুলতা। এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম সময়ের আলোকে বলেন, ‘এসব পণ্যের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে ম্যানমেইড ফাইবার, যার সিংহভাগই চীনে উৎপাদন হয়। এসব কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করতে হয়, দেশে তৈরি হয় না। এ জন্য বিজিএমইএ’র তরফ থেকে ম্যানমেইড ফাইবারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। গত বাজেটে আমরা এ পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ প্রণোদনা চেয়েছিলাম, কিন্তু সরকার সেটি দেয়নি। প্রণোদনা দিলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হতেন। একটা সময় বিশ^বাজারে ৭০ শতাংশ কটন পণ্যের দখলে ছিল, আর ৩০ শতাংশ ছিল ম্যানমেইড ফাইবারের দখলে। এখন সেটি উল্টো হয়েছে। এখন বিশ^বাজারের ৭০ শতাংশই ম্যানমেইড ফাইবারের দখলে, ৩০ শতাংশ কটনের। পিপিইসহ যেসব টেকনিক্যাল পণ্যের বাজারের কথা বলা হচ্ছে তার কাঁচামালের পুরোটাই হচ্ছে ম্যানমেইড ফাইবার। সুতরাং এখানে সরকারের নজর দেওয়ার দরকার আছে এবং কাঁচামাল তৈরির জন্য ব্যাপক বিনিয়োগের দরকার আছে।

তিনি আরও বলেন, পোশাক রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে চীন। তাদের বাজার শেয়ার এখন ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান (দ্বিতীয়)। বাংলাদেশের অংশ ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তার মানে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বিশাল তফাৎ। চীন কিন্তু এখন ম্যানমেইড ফাইবারের ওপর জোর দিয়ে আরও এগিয়ে গেছে। আমাদের সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী দেশ ভিয়েতনামও ম্যানমেইড ফাইবারের দিকে জোর দিয়েছে। এ জন্য তারা তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও ভ্যালু অ্যাডিশনে কিন্তু তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে। সুতরাং দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে এবং হাই ভ্যালু পণ্য রফতানি বাড়াতে ম্যানমেইড ফাইবারকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই।

‘গিজ’-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনও টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই পণ্যের বড় ক্রেতা ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার ধরার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্বব্যাপী টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বাজারের আকার এখন প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের সামনে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও বলতে গেলে এই বাজার এখনও অধরা। এর পেছনে রয়েছে মূলত পাঁচটি কারণ- বাজারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, উচ্চ কর্মক্ষম কাঁচামালের অভাব, কমপ্লায়েন্স ও সার্টিফিকেশন এবং মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা।

টেকনিক্যাল টেক্সটাইলে সাধারণত নান্দনিক উদ্দেশ্যে পণ্য তৈরি করা হয় না। এখানে কার্যক্ষমতাই হলো পণ্যের প্রাথমিক মানদণ্ড। বর্তমানে প্রযুক্তিগত বা টেকনিক্যাল টেক্সটাইল উপকরণগুলো ফিল্টার পোশাক, আসবাবপত্র, স্বাস্থ্যবিধি ও চিকিৎসা এবং নির্মাণসামগ্রীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি মাস্ক এবং পিপিইও টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের অন্তর্ভুক্ত।

গিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের আকারই মাঝারি ধরনের। এমনকি টিটি/পিপিই পণ্যের বড় পোশাক গোষ্ঠীগুলো আন্তর্জাতিক ক্রয় সংস্থাগুলোর কাছে পরিচিত নয়। এ ছাড়া মেডিকেল পিপিই পণ্যের সোর্সিং সাপ্লাই চ্যানেল তৈরি পোশাকের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। তাই ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর জন্য পণ্যের কার্যক্ষমতা, পরীক্ষা এবং সনদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।’

ধারণা করা হচ্ছে, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ২২৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যেখানে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার হবে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। আবার এদিকে বিশ^ব্যাপী পিপিইর বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ৯৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলেও অনুমান করা হচ্ছে।

এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে ৬১৮ মিলিয়ন ডলারের মাস্কসহ পিপিই রফতানি করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি। এর বাইরে অন্যান্য টেকনিক্যাল টেক্সটাইল পণ্য কী পরিমাণ রফতানি হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি।

তবে পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, বাংলাদেশ এখনও তার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশও রফতানি করতে পারছে না। অথচ তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবদান ৬ শতাংশেরও বেশি। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, তাদের সদস্যভুক্ত ১৫৫টি প্রতিষ্ঠান মাস্ক ও পিপিই রফতানি করে থাকে। এর মধ্যে বিশ্বের ১৯টি দেশে মাস্ক ও ৬টি দেশে পিপিই রফতানি করা হচ্ছে।

কাঁচামাল সংগ্রহ এবং পণ্যের গুণমান পরীক্ষা বা সনদের মান সংক্রান্ত জটিলতাকে গবেষণায় বাংলাদেশের টেকনিক্যাল টেক্সটাইল রফতানিতে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে দক্ষতার সঙ্গে উৎপাদনের জন্য কারখানাগুলোকে প্রযুক্তিগতভাবে আরও উন্নত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ উপযুক্ত কাঁচামাল সংগ্রহ এবং মানসম্মত উৎপাদন নিশ্চিত করবে। এ ছাড়া অন্যান্য বিভাগ পণ্যের গুণমান পরীক্ষা এবং সনদের মান ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে। বাংলাদেশ একবার নতুন এই পণ্য খাতে সুনাম, আত্মবিশ্বাস এবং নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করতে পারলেই ধীরে ধীরে আরও বৈচিত্র্যময় এবং অত্যাধুনিক পণ্যের উৎপাদনে মনোযোগ দিতে পারবে এবং এভাবে পরে মুনাফার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।

সীমিতসংখ্যক পণ্য দিয়ে শুরু করেও যদি সেগুলো মানসম্মতভাবে উৎপাদন করা হয়, তা হলে এটি অন্যান্য নতুন পণ্য এবং বাজারের দরজা খুলে দেবে। প্রারম্ভিক নির্মাতাদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আরও অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান এই খাতে ব্যবসা করতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মেডিকেল টেক্সটাইল পণ্য আমদানি করে ইউরোপ। তবে উত্তর আমেরিকাতেও এই ধরনের পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং বাড়তে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ পৃথিবীতে টেকনিক্যাল টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা ও ব্যবহার অফুরন্ত হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একবার নির্মাতারা নির্ভরযোগ্য সামগ্রী সরবরাহ করতে পারলে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম উন্নত এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সনদে পণ্যের মান ধরে রাখার পদ্ধতি শিখে নিতে পারলেই সামনে রয়েছে পণ্য বৈচিত্র্যের বিশাল সুযোগ।




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close