যে বছর আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েছিলাম (২০০৪), উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সে বছরই শিক্ষকতা থেকে আনুষ্ঠানিক অবসর নেন। তাতে অবশ্য আমার খেদ ছিল না। কেননা আনুষ্ঠানিক সেই অবসর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। আমাদের কখনও মনে হয়নি, হাসান স্যার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক; চাইলেই তাকে পাওয়া যেত, যেকোনো প্রতিবাদে-প্রতিরোধে-প্রগতির মিছিলে। তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের খুব কাছের মানুষ।
তার সাহিত্য বিচার এই ছোট্ট লেখাটির উদ্দেশ্য নয় কোনোমতেই। জাতিরাষ্ট্রের সীমানায় ভাগ হওয়া দেশ নিয়ে, নামহীন-গোত্রহীনদের নিয়ে, পাতালে-হাসপাতালে ক্রন্দনরত মানুষ নিয়ে, আগুনপাখির দেশ হারানো যাত্রা কিংবা পৌঁছানোর শান্তি না থাকা কিংবা হাসানের জাদুবাস্তবতা নিয়ে আলাপের মানুষ আছেন অনেকেই। আমি কেবল আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে দুয়েকটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করতে চাই।
২৬ আগস্ট, ২০০৬ (তারিখটা মনে ছিল না। সহযোদ্ধা বন্ধু আরিফ রেজা মাহমুদ মনে করিয়ে দিলেন)। সেটা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়। হাসান স্যারকে প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে হত্যার হুমকি দিল শিবির। এর কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক খুন হয়েছেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির মানে কী; আমরা যারা সেখানকার শিক্ষার্থী ছিলাম তারা জানি। ভয়ে ‘শিবির’ শব্দটিও তখন উচ্চারণ করা কঠিন ছিল।
হাসান স্যার এই হুমকি পাওয়ার পরপরই গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন (কেবল হাসান স্যার সেখানে রয়েছেন বলেই যে মানুষটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন) আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে হাসান স্যারের বিহাসের বাসায় গেলেন। নিউটন ভাইকে (সরাসরি শিক্ষক হলেও নিউটনকে আমরা ভাই-ই ডেকেছি, ছাত্র থাকাকালেও) দেখেই বারান্দা থেকে নি-উ-ট-ন বলে চিৎকার দিলেন স্যার। এরপর স্যারের লাইব্রেরিতে গিয়ে আড্ডা।
তাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, কিছু সময় আগে হত্যার হুমকি পেয়েছেন তিনি। আড্ডার ফাঁকে হাসান স্যারকে যখন সতর্কতার কথা বলা হলো, পাত্তাই দিলেন না তিনি। তাকে নিয়ে এত ভাবতে বারণ করলেন।
হাসান স্যারের সঙ্গে আরেকটা প্রত্যক্ষ স্মৃতি ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টারের একটা পত্রিকার জন্য (সম্ভবত প্রান্তজন) তার সাক্ষাৎকার নেওয়া। ১০ মিনিটের মতো সাক্ষাৎকার, খুবই ধরাবাঁধা প্রশ্ন। উনি তেমন একটা আগ্রহ পাচ্ছিলেন না। তবে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার শেষ হতেই উনি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। ঘণ্টাদেড়েক গল্প করেছিলেন সমাজ-রাজনীতি নিয়ে। একপাক্ষিক বলে যাওয়াটা তার স্বভাবে ছিল না, আমি যেভাবে দেখেছি। শুনতেও পছন্দ করতেন।
হাসান স্যার দূরের মানুষ ছিলেন না বলেই, সাহিত্যিক হিসেবে তার বিশালতা আমাদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি করতে পারেনি। সেমিনারে, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে, শুভ আর মঙ্গলের পক্ষের যেকোনো আয়োজনে তাকে পাওয়া যেত অনায়াসে।
১/১১-এর সেনা-করপোরেট সরকারের বাস্তবতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার কথা, জরুরি বাস্তবতাকে বোঝার কথা, পরিস্থিতি উত্তরণের কথা বলতে শোনা যেত না বলতে গেলে প্রায় কাউকেই। প্রগতিশীল ছাত্রজোট কিংবা রবীন্দ্রগ্রুপ নামে প্রগতিশীল শিক্ষকরা তখন একরকম গর্তে ঢুকে পড়েছেন ভয়ে। অবসর না নেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে তখন সেলিম রেজা নিউটন আর আমরা ছোটকাগজ করা কিংবা ছাত্র ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কৃত কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠন করা কিংবা কিছুই না করা তার কিছু বন্ধু-শিক্ষার্থী মিলে তখন প্রতিরোধ রচনার চেষ্টা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যেই ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনা-শিক্ষার্থী সংঘাত, ২১ আগস্ট জরুরি আইন ভেঙে আমাদের মিছিল আর পরবর্তীতে কারও কারও জেলযাপন আর আমাদের কারও কারও ফেরারি জীবন- সাক্ষ্য দিচ্ছি এই পুরো সময়টা হাসান স্যার আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ‘ভয়’ শব্দটি হাসানের অভিধানে ছিল বলে আমার মনে হয় না।