নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল ইতোমধ্যে অংশ নিয়েছে। তবে বিএনপি, সিপিবি ও বাসদসহ কয়েকটি দল সংলাপে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে উদ্যোগটি পুরোপুরি সফল হবে কি না তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
সংলাপে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সংলাপে যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হয় না। তাদের দেওয়া কোনো প্রস্তাবের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো কমিশন গঠন করা হয়। তাই সংলাপে অংশ নেওয়া সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিএনপির যোগ না দেওয়ার ঘোষণাকে গণতন্ত্রের জন্য ‘খারাপ খবর’ হিসেবে বর্ণনা করেছে আওয়ামী লীগ।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে ২০ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রথম দিন জাতীয় পার্টি সংলাপে অংশগ্রহণ করে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দলীয় নেতার স্ত্রীর নাম প্রস্তাব করে সাধারণ মানুষের মাঝে হাস্যরসের জোগান দিয়েছে। ২২ ডিসেম্বর ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সংলাপে অংশ নিয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের পক্ষে সায় দিয়েছে। তবে তারা কোনো নাম প্রস্তাব করেনি। ২৬ ডিসেম্বর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সংলাপে অংশ নিয়ে ইসি গঠনে আইনি কাঠামো প্রণয়ন ছাড়াও নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও শক্তিশালী করা; সৎ, যোগ্য, নির্মোহ ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগদান; নির্বাচনে পবিত্র ধর্মের অপব্যবহার, অস্ত্র ও পেশিশক্তি ব্যবহারকারীদের তাৎক্ষণিক গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদান; স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার প্রস্তাব দেয়।
২৬ ডিসেম্বর সংলাপে অংশ নেওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ)। কিন্তু গত ২৪ ডিসেম্বর সংলাপে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রপতির দফতরকে জানিয়ে দেয় দলটি।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, এর আগে দুইবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এবং দুই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে সংবিধানের আলোকে ইসি গঠন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা ও নিয়োগ কাঠামো তৈরি এবং ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্বের বিধান করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি; কিন্তু ওইসব সংলাপে দলের পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলাম তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তাই নতুন করে সংলাপে অংশ নেওয়াটা হবে রাষ্ট্রপতির সময় নষ্ট করা। তাই বাসদ মনে করে সংলাপে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। রাষ্ট্রপতির দফতরকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি, আমরা শুধু শুধু সংলাপে গিয়ে রাষ্ট্রপতির মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। তিনি চাইলে বাসদের আগের প্রস্তাবগুলোই বাস্তবায়ন করতে পারেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিবি) আগামী ৩ জানুয়ারি সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নেবে না বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
সময়ের আলোকে তিনি বলেন, সংলাপের যে বিষয়বস্তু সে বিষয়ে আমরা ২০১৬ সালেই প্রস্তাব দিয়েছি; কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। সংলাপের যে আলোচ্যসূচি গতবার ছিল, এবারও তাই। তাই নতুন করে আর এ বিষয়ে কথা বলার কিছু নেই। এই সংলাপে অংশগ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। রাষ্ট্রপতি সংলাপ না করে বরং এক মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করার নির্দেশনা দিয়ে সংসদের কাছে চিঠি পাঠাতে পারেন।
সংলাপের আমন্ত্রণ পাওয়ার আগেই বিএনপি গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তারা সংলাপে অংশ নেবে না।
দলটির স্থায়ী কমিটির সভায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া অন্য কোনো ইস্যুতে সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আমরা সংলাপে যাব না। কারণ এটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা একটা নাটক। কারণ অতীতেও সংলাপ করে কোনো স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব হয়নি। আমাদের কথা হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। তাই সেটা সবার আগে দরকার। তারাই নির্বাচন কমিশন গঠন করবে।
তিনি বলেন, বিএনপিসহ অনেক দলই সংলাপে যাচ্ছে না। আর এই বর্জনে আমরা লাভ দেখছি। কারণ অংশ নিয়ে এ সংলাপকে বৈধতা দেওয়ার কোনো কারণ মনে করি না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সময়ের আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির এই সংলাপ লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তাই এই সংলাপে কে গেল আর কে না গেল এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রী যেভাবে পরামর্শ দেবেন রাষ্ট্রপতি সেভাবেই নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
তিনি বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা হলো সংলাপের মাধ্যমে গঠিত দুটি নির্বাচন কমিশনই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন না করে একই পদ্ধতিতে আরেকটি কমিশন গঠন করা হলে ফলাফল আগের মতোই হবে। তাই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ অনেকটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হবে বলেই মনে হচ্ছে। এ ধরনের সংলাপের কোনো মানেই হয় না।
রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিএনপির যোগ না দেওয়ার ঘোষণাকে গণতন্ত্রের জন্য ‘খারাপ খবর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, সংলাপে না এলেও ভোটকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ করতে’ বিএনপি ‘নির্বাচনে আসবে’ বলেই তার ধারণা।
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সংলাপে আসবে না, এটা দেশের গণতন্ত্রের জন্য খারাপ খবর। তবে গাধা যেমন পানি ঘোলা করে খায়, বিএনপিও পানি ঘোলা করে নির্বাচনে আসবে। সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো ইসি গঠনে আইন করার পক্ষে যে মত দিয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওবায়দুল কাদের বলেন, এবারই আইনটা হতো, মহামারির কারণে সম্ভব হয়নি, এবার না হলে আগামীবার হবে। এবার সময় একেবারেই হাতে নেই। এই সময়ে আইন করার মতো পরিস্থিতি একেবারেই ছিল না। সার্চ কমিটি গঠন, যেটা এবার হচ্ছে, গতবারও হয়েছে, সেটাও আইনের বাইরে নয়, নিয়মের বাইরে নয়, সংবিধানের বাইরে নয়।