ই-পেপার বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪

ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তির চার বছর
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কতদূর!
প্রকাশ: শনিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২২, ১:৩৯ পিএম  (ভিজিট : ২৯২)
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ২০১৮ সালের মধ্য জানুয়ারিতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি হয়। এই চুক্তির পর কেটে গেছে চারটি বছর। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে করা ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, প্রত্যাবাসন শুরু করে ‘সম্ভব হলে তা দুই বছরের মধ্যে’ শেষ করা হবে। কিন্তু রাখাইনে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় দুই দফা তারিখ চূড়ান্ত করেও রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানোর চেষ্টা বিফলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আদৌ ফেরত পাঠানো যাবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

দেশান্তরী রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৫ লক্ষাধিক, যার মধ্যে বাংলাদেশের সরকারি তথ্য মতে, প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে বসবাস করছে। এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ভরণপোষণ ও বসবাসের ব্যবস্থা করতে, ছোট্ট এই ব-দ্বীপের জন্য রীতিমতো নাভিশ^াস তোলার অবস্থা হচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে ওরা, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে অবৈধ অস্ত্র থেকে শুরু করে নানা রকমের মাদক এদেশের ভূখণ্ডে পাচার করছে সঙ্ঘবদ্ধ চক্র।

শুধু জানুয়ারি মাসেই তিনবার উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগে। এত ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনা, একেবারে সন্দেহাতীতভাবে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। 

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে পরিকল্পিতভাবে তার নিজ বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যার পর ঠিক ১ মাসের মাথায় পুলিশ (এপিবিএন) পাঁচজনকে আটক করে, যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে দাবি করে ও তার মধ্যে একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

চাঞ্চল্য তৈরি করা এ ঘটনা, কারা ও কেন ঘটিয়েছে তা নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয় দেশে ও বিদেশে। সেই রহস্য আরও দৃঢ় হয় যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহিব্বুল্লাহর হত্যার পর সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, ‘তাকে হত্যার পেছনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা থাকতে পারে।’

মুহিব্বুল্লাহর মৃত্যুর পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে তার প্রায় সব পরিচিত রোহিঙ্গাও সন্দেহ প্রকাশ করে যে তার হত্যার পেছনে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীরই একদল জড়িত। অনেকে এর পেছনে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হাত রয়েছে বলে দাবি করছেন। তাদের মতে আরসা চায় না মুহিব্বুল্লাহর নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হোক। এই সন্দেহ আরও প্রবল হয়ে ওঠে যখন এই মাসের ১৬ তারিখ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আটক করা হয় জঙ্গি সংগঠন আরসার প্রধান আতাউল্লাহর ভাই শাহ আলীকে অস্ত্র ও মাদকসহ। বর্তমানে সে রিমান্ডে আছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও নাশকতার মামলা করেছে পুলিশ।

মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাচে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল শহীদুল হক বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানকে ব্যবহার করে উপমহাদেশে ইয়াবা, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র এসব চালিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী ও আরাকান রাজ্যের প্রভাবশালীরা সব ধরনের প্রত্যাবাসন বিষয় পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে চায়।’

এমতাবস্থায় দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো জরুরি। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের নেওয়া কোনো উদ্যোগই ফলপ্রদ হয়নি। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা সেনাবাহিনীর সরে দাঁড়ানোর পরই ২০১৬ সালে যখন কারাবাস থেকে মুক্তি দিয়ে অং সান সু চিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে বিশে^র থেকে কূটনৈতিক ও আর্থিকভাবে বিছিন্ন থাকা মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তার পরপরই সু চি চীন ও পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের তৎপরতা শুরু করেন। ঠিক তার কিছু মাস পরেই ২০১৭ সালের শুরুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দ্বারা রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। 

যাতে বিভিন্ন বার্তা সংস্থা দাবি করে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়। এ খবর বেরিয়ে আসা মাত্রই বৈশি^কভাবে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও সু চির বিরুদ্ধে। দীর্ঘ ৩ মাসের বেশি সময় ধরে চলা সংঘর্ষে ৫-৭ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। মূলত রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্য ছাড়া করাই ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য।

বৈশ্বিক তীব্র চাপের মুখে পড়ে, মিয়ানমারের সরকার লোক দেখানো নাটকের অংশ হিসেবে, ‘চীনের মধ্যস্থতায় আলোচনা শুরু করে, মিয়ানমার ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রাথমিকভাবে ৮৪০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওই তালিকা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু আপত্তির পর তা শেষ পর্যন্ত ৭১১-এ নেমে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ডিসেম্বরে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দুপক্ষ থেকে ১০ জন করে ২০ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি করার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ১০ জনের নাম মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছে।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা নাটকীয়ভাবে আবারও ক্ষমতা দখলের পর দ্বিতীয়বারের মতো আলোচনার এ প্রস্তাব দেয়। যা শুধু কালক্ষেপণের জন্য তাদের অতীত কৌশল বাদে আর কিছু নয়। ফলস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।

আশার কথা এই যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত গণহত্যা মামলায় ২১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের প্রধান বিচার বিভাগীয় সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের প্রত্যাশা, বৈশ্বিক প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারকে বাধ্য করবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে। প্রকৃতপক্ষে এতেই রোহিঙ্গা, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সবার জন্য মঙ্গল।

জয় চক্রবর্ত্তী, কক্সবাজার




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close