ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৭নং ওয়ার্ডে নেই কোনো খেলার মাঠ বা পার্ক। তেঁতুলতলা, লেক সার্কাস ও গ্রিন রোড এলাকায় খোলা জায়গা বলতে সড়ক আর বাসার গলি ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। এর মধ্যে একটুকরো প্রশান্তি ছিল তেঁতুলতলা মাঠ। তাও আবার সরকারি সংস্থার স্থাপনা নির্মাণ করে আগে থেকেই সঙ্কীর্ণ করে রাখা হয়েছে। যেটুকু বাকি ছিল, সেখানেও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাসানো হয়েছে পুলিশি পাহারা।
স্থানীয়দের ভাষ্য, পুলিশের এই পাহারা কোনো চোর বা ডাকাত ধরার জন্য নয়, কোমলমতি শিশু-কিশোররা যাতে মাঠে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তার নামে শিশু-কিশোরদের নির্যাতনের নজিরও রয়েছে। থানা নির্মাণের আগেই যদি কোমলমতি বাচ্চাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়, তবে থানা নির্মাণ করতে পারলে এখানে কী হবে তা নিয়েও চিন্তিত বাসিন্দারা। তারা মনে করছেন, যেভাবে মাঠ দখল করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে এতে মনে হচ্ছে পুলিশ মাঠটি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু কোনোক্রমেই এই মাঠে থানা বা অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না বলে জানায় তারা।
তা ছাড়া ঢাকায় খোলা জায়গা বা মাঠের এমনিতেই সঙ্কট রয়েছে। এর মধ্যে যদি অলিগলির ছোট জায়গাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়, তবে মানুষের নিশ্বাস নেওয়ার আর কোনো জায়গা থাকবে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাই এই মাঠটি শিশুদের ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র থানা নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সোমবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, লেক সার্কাস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের সড়ক দিয়ে গ্রিন রোডের দিকে যেতে হাতের বামপাশেই বসে আছে চারজন পুলিশ সদস্য। অন্য একজন মাঠের কাঁটাতারের পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাঠের নিরাপত্তার জন্যই ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের পাঠানো হয়েছে। যেখানে কলাবাগান থানার একজন এএসআই ছাড়াও মিরপুর এলাকার চার পুলিশ সদস্য রয়েছে।
মাঠে কেউ ঢুকতে চাইলে তারা বাধা দিচ্ছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এক পুলিশ সদস্য জানান, সারাদিনে কেউই মাঠে ঢুকতে চায়নি। তবে যেহেতু নিরাপত্তার বিষয় জড়িত, তাই কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
মাঠের পূর্বপাশে বড় সীমানা দেয়াল এবং আবাসিক ভবন রয়েছে। পশ্চিম পাশে ঈদের নামাজের জন্য মিম্বার রয়েছে। এর পাশেই রয়েছে একটি ঘর। স্থানীয়রা জানান, কেউ মারা গেলে এই ঘরে গোসল দিয়ে কাফন পরানো হয়। এরপর মাঠেই জানাজা হয়। তাই এই মাঠে থানা ভবন নির্মাণ করা হলে এলাকাবাসীর জানাজা বা গোসল দেওয়ারও কোনো জায়গা অবশিষ্ট থাকবে না।
মাঠের পশ্চিম প্রান্তে ঢাকা ওয়াসার পানির পাম্প। এক সময় এই পাম্পের জায়গাও মাঠের অংশ ছিল বলে জানান স্থানীয়রা। পূর্বপাশের কিছু অংশ ময়লা ও মাটি দিয়ে ভরাট করা। দক্ষিণ পাশের দেয়ালে হেলেপড়া একটি সাইনবোর্ড দেখা গেছে। যেখানে লেখা আছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের কলাবাগান থানার নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গা।
মাঠের ভেতরে খেলাধুলা করার বিভিন্ন উপকরণ এখনও রয়ে গেছে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে ফুটবল খেলার দুটি মিনি গোলবার রয়েছে। মাঝখানে ব্যাটমিন্টন খেলার কোর্ট রয়েছে। এখানে বিকালবেলা মিনি ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাটমিন্টন খেলা ছাড়াও প্রায়ই ছোট ছোট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হতো। কিছুদিন আগে শেষ হওয়া বঙ্গবন্ধু কাপ ডে-নাইট ফুটবল টুর্নামেন্টের সাইনবোর্ড এখনও ঝুলছে দক্ষিণ পাশের দেয়ালে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন বলে জানা গেছে।
সোমবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত মাঠের আশপাশে কোনো শিশু-কিশোরকে দেখা যায়নি। তবে বিকালের দিকে বিল্ডিংয়ের ছাদ বা বেলকুনি থেকে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেছে অনেক শিশুকে। ওয়াসার পানির পাম্পের অদূরে একটি বিল্ডিংয়ের সামনে পাঁচ-ছয় কিশোরকে গল্প করতে দেখা গেছে। তারা জানায়, মাঠে খেলতে দেয় না তাই সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের একজন জানায়, পুলিশ পাহারা দিচ্ছে তাই মাঠের কাছে কেউ যাচ্ছে না। অন্য একজন পুলিশের নির্যাতনের শিকার কিশোরদের প্রসঙ্গ তুলে আনে। আবরার নামে এক স্কুলশিক্ষার্থী জানায়, মা-বাবা বারণ করেছে মাঠের কাছে যেতে। আর পুলিশও ভয়ভীতি দেখায় তাই যাই না।
জোহর নামাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন কয়েকজন। এ সময় এলাকার বাসিন্দা আমির আলী জানান, এ এলাকায় খেলার মঠ, ঈদগাহ মাঠ, জানাজার জায়গা, লাশ গোসলের জায়গা যাই বলেন, এই তেঁতুলতলা মাঠই একমাত্র ভরসা। এ মাঠে থানা নির্মাণ করা হলে এ এলাকার বাসিন্দারা এক ধরনের বন্দি হয়ে যাবে। তাই সরকারকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
হাসান জাবেদ নামে এক যুবক জানায়, ছোট সময় এই মাঠে আমরাও খেলেছি। এখন বাচ্চারা খেলছে। এই মাঠে কোনোভাবেই ভবন নির্মাণ করা ঠিক হবে না। এলাকাবাসীর একজন আক্ষেপ করে বলেন, খেলাধুলা না হয় বাদই দিলাম, মারা গেলে লাশ গোসল আর জানাজা দেওয়ার জায়গাও থাকবে না- এটা ভাবলেই কষ্ট লাগে।
তবে শিশুদের মানসিক বিকাশে খেলার মাঠ রক্ষার দাবি জানিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সময়ের আলোকে বলেন, জনঘনত্ব অনুযায়ী এ এলাকায় ৪ থেকে ৫টি মাঠ থাকার প্রয়োজন। যেহেতু খেলার মাঠ নেই, তাই তেঁতুলতলা মাঠটি বাচ্চাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া উচিত। কেননা খেলাধুলা শিশুদের অধিকার। এ অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত না করে সরকারের উচিত হবে অন্য কোথাও থানা নির্মাণ করা।
এদিকে মাঠ রক্ষায় মানববন্ধন ও আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা দাবি তুলছে এলাকাবাসী। এর মধ্যে জনমত গঠনে ‘তেঁতুলতলা মাঠ আমাদের প্রাণের দাবি’ নাম দিয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছে। যেখানে প্রায়ই নানা পোস্ট দিচ্ছে আন্দোলনকারীরা।
সৈয়েদা রত্না নামে একজন লিখেছেন, ‘যেদিন বাচ্চাদের খেলার মাঠটিকে আপনারা অন্য স্থাপনার কথা ভাবলেন, সেদিন থেকেই বাচ্চাদের মানসিক নির্যাতন শুরু করে দিলেন। বাচ্চারা যখন শুনতে পেল এই মাঠ আর ওদের থাকবে না, সেদিন থেকে ওদের মনে হারাবার ভয় দানা বাঁধতে শুরু করে। ভয়, হতাশা, অসহায়ত্ব থেকে শিশুমনে ক্ষোভ জন্ম নেয়।’
ফুটবল খেলার সময় ছয় বন্ধুর জার্সি গায়ে দেওয়া ছবি যুক্ত করে মোশারফ হোসেন লেখেন, ‘এই মাঠেতেই খেইলা ধুইলা বড় ইইছি আমি। কলাবাগানকে মাদকমুক্ত রাখতে এই মাঠটি আমাদের দরকার।’
প্রসঙ্গত, এর আগে থানা নির্মাণের জন্য এই মাঠে কাঁটাতারের বেড়া দেয় পুলিশ। মাঠে ঢোকার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা দেয় তারা। পুলিশের এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে খেলতে যাওয়া শিশু-কিশোরদের নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা বাচ্চাদের কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে এবং এই মাঠে খেলতে আসবে মর্মে জবানবন্দি আদায় করে ভিডিও করছে। তবে এই ভিডিও দেখে রোববার চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
/আরএ