জ্বালানি তেলের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ও লুটপাটের প্রতিবাদে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো বিক্ষোভ সমাবেশে বেদম ‘লাঠিচার্জের’ পর এবার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে পুলিশ। ‘পুলিশের ওপর আক্রমণের’ অভিযোগ এনে ২১ জনের নাম উল্লেখ ও ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাত করে সোমবার (৮ আগস্ট) শাহবাগ থানায় মামলা করেন এসআই পলাশ সাহা। আন্দোলনে উপস্থিত নয় এমন অনেককে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে চিকিৎসাধীন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দীপ ভট্টাচার্য ও আন্দোলনে না থাকা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান রিচার্ডকে আসামি করা হয়েছে।
এদিকে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদসহ তিন দফা দাবিতে রাস্তায় নেমেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের ‘হামলার’ প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করেছে জোটের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া শাহবাগে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ব্যানারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা :
থানার অপারেটর মোসাদ্দেকুল হক বলেন, বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা বেআইনিভাবে জনতাবদ্ধ হয়ে দাঙ্গার উদ্দেশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে লাঠিসোটা, ইটপাটকেলসহ পুলিশের কাজে বাধা দেওয়াসহ হত্যার উদ্দেশে আক্রমণ করে গুরুতর রক্তাক্ত করে জখম করার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা করেছে। এজাহারে বলা হয়েছে, এসব আক্রমণে ২১ জন সরাসরিভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও অজ্ঞাতপরিচয় ২০-৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আসামিরা হচ্ছেন- ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সহসভাপতি অনিক রায়, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সোহেল, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি আরিফ মঈনুদ্দীন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুনয়ন চাকমা, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি তৌফিকা প্রিয়া, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দীপ ভট্টাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য শান্তা ও ছাত্র ফেডারেশনের জুবা মনি। এজাহারে সানি আবদুল্লাহ, জাবিল আহম্মেদ জুবেন, জাওয়াদ, বাঁধন, আদনান, শাহাদাত, ইভান, অনিক, দিয়া মল্লিক, তানজিদ ও তামজিদ নামের ১১ জনের নাম দেওয়া হলেও পরিচয় দেওয়া হয়নি।
তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ : জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সোমবার দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নিয়েছে সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ ছাত্ররা। তারা তিন দফা দাবিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বলেন, সরকার গত ৭ আগস্ট রাতে হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা করে। এর ফলে গণপরিবহনের ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত এ ভাড়া বহন করা জনসাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এটি আরও বেশি অসম্ভব। দ্রুত জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে জনদুর্ভোগ কমাতে সরকার সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভ সমাবেশে সাত কলেজ শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ইসমাইল সম্রাট বলেন, গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নামে নৈরাজ্য চলছে। চলমান এ নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। পরিবহন মালিকরা ওয়েবিল করার কারণে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে প্রায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি অর্থ গচ্ছা দিতে হচ্ছে যাত্রীদের। যাত্রীদের গলার কাঁটা এই ওয়েবিল অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
আবুল কাশেম মজুমদার নামের একজন অভিভাবক বলেন, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াত করে। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির এই হটকারি সিদ্ধান্তের ফলে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আয়-ব্যয়ের যদি সমন্বয় না হয় তা হলে একজন শিক্ষার্থী পারিবারিক, শিক্ষাক্ষেত্রসহ সর্বত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশে দেশপ্রেমিক মঞ্চের সমন্বয়ক ড. শাহরিয়ার ইফতার সংহতি জানিয়ে বলেন, সরকার ঋণ নেওয়ার শর্তের অংশ হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। একদিকে তারা বলছে তাদের রিজার্ভের পরিমাণ ৪২ বিলিয়ন, অন্যদিকে তারা আইএমএফের কাছে ঋণ চাচ্ছে। বিশ^বাজারে যখন তেলের দাম বৃদ্ধি হয়েছে সেদিন বাংলাদেশেও ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। অথচ বিশ^বাজারে যেদিন কমতে শুরু করেছে সেদিন এই সরকার ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। অথচ দেশের বেতন কাঠামো তো বাড়ছে না, তা হলে মানুষ কীভাবে চলবে? আমরা সরকারকে তিন দিন সময় দিচ্ছি। আপনারা পূর্বের জায়গায় ফিরে আসুন। জনগণ যখন মাঠে নেমে আসবে তখন বুঝবেন জনগণের শক্তি কি। সময় থাকতে সচেতন হোন। অন্যথায় আপনাদের রাজাপাকসের মতো অবস্থা হবে। তিন দফা দাবির মধ্যে রয়েছেÑ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বৃদ্ধিকৃত জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হবে, গণপরিবহনে এক পয়সাও ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে না এবং গণপরিবহনে ভাড়ার নামে নৈরাজ্য বন্ধ করাসহ সব শিক্ষার্থীর হাফ পাস নিশ্চিত করা।
হামলার প্রতিবাদে মিছিল, শাস্তি দাবি : গত রোববার সন্ধ্যায় বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর ডাকা শাহবাগের বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশ ব্যাপক লাঠিপেটা ও হামলার প্রতিবাদে সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে ৯টি বাম ছাত্র সংগঠনের যৌথ বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের কলাভবন, ডাকসু, গ্রন্থাগার ও কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে দিয়ে শাহবাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকায় শেষ হয়। মিছিলে ‘পুলিশ লীগের হামলা, রুখে দাঁড়াও বাংলা’, ‘শাহবাগে হামলা কেন, শেখ হাসিনা জবাব চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দেন জোটের নেতাকর্মীরা। কর্মসূচির সময় শাহবাগে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেলেও তারা মিছিলে বাধা দেয়নি।
টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে পাদদেশে মিছিল পরবর্তী সমাবেশে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ পুলিশ নৃশংস হামলা চালিয়েছে। এর প্রতিবাদেই আমাদের এ বিক্ষোভ মিছিল। বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সোহেল বলেন, সরকার অযৌক্তিকভাবে রাতের অন্ধকারে তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। কেবল তেল নয়, সব পণ্যের দামই বেড়েছে এবং বাড়ছে। দেশ থেকে টাকা পাচারের মহোৎসব শুরু করেছে এ সরকার। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা এ দেশে থাকবেন না। তাদের সন্তানরা বিদেশে থাকবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারাও বিমানের টিকেট রেডি করে রেখেছেন।
মামলার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ : লাঠিচার্জের পর পুলিশের করা মামলার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে একে অযৌক্তিক বলেছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের দফতর সম্পাদক সালমান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, পুলিশ আমাদের ওপর হামলা করেছে। অথচ মামলা করা হয়েছে আমাদেরই বিরুদ্ধে। এজাহারে তারা বলেছে, আমরা তাদের হত্যার উদ্দেশে হামলা করেছি। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দীপ ভট্টাচার্য গতকালের সমাবেশে না থাকলেও তাকে মামলার আসামি করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে চিকিৎসার জন্য ভারতে অবস্থান করছেন। ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান রিচার্ডও গতকালের সমাবেশে ছিলেন না। তাকেও আসামি করেছে পুলিশ।
শিক্ষার্থীদের গণ-অবস্থান চলবে : জ্বালানির দাম বাড়ানোকে অযৌক্তিক দাবি করে এর প্রতিবাদে ‘বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে শিক্ষার্থীদের গণঅবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে তারা এ অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন। গত শুক্রবার শিক্ষার্থীদের এই অংশটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিলে তারাও পুলিশের হামলার শিকার হয়। সোমবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী ১২ আগস্ট গণসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। শাহীদুল ইসলাম আপন বলেন, ১২ আগস্ট বেলা ৩টায় শাহবাগে জাদুঘরের সামনের শাহবাগ চত্বরে গণসমাবেশের ডাক দিয়েছি। সেখানে ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আমরা আহ্বান করা হয়েছে। আর আমাদের অবস্থান কর্মসূচি প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলবে।