সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বনন্দিত রাজনীতিক, ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিকামী মানুষের অধিকার আদায়ে তাঁর আপসহীন নেতৃত্বের সৌকর্য তাঁকে আসীন করেছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতার আসনে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিকৃষ্টতম কালো অধ্যায়ের সূচিত হয়। সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের ষড়যন্ত্র বিশ্লেষণে ইতিহাসের কিছু অমোঘ সত্যের সন্ধান মেলে। যে সত্যের উন্মোচন করা না হলে ইতিহাস অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে।
পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্তে সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের নাম সামনে আসে ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। ব্রিটিশ আইটিভির ‘ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ সাক্ষাৎকারে বলেছিল, এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে জিয়াউর রহমান তাদের সঙ্গে ছিলেন। শুধু তাই নয়, খুনিদের প্রস্তাবের পর তিনি তাদের ‘এগিয়ে যাও’ বলার মধ্য দিয়ে সরকার উৎখাতসহ অপরাপর অপরাধ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
লে. কর্নেল আমিন উদ্দিন চৌধুরী ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তুলে ধরেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মেজর রশীদের নেতৃত্বে সৈন্যরা তাকে এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে যায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে। জিয়াউর রহমানের বাড়িতে প্রবেশের সময় আমিন উদ্দিন চৌধুরী জানতে পারেন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিন উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করেছেন, একদিকে শেভ করেননি। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে এলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাফায়াত কী হয়েছে?’ শাফায়াত বললেন, ‘অ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজড এ ক্যু। বাইরে কী হয়েছে এখনও আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন।’ তখন জেনারেল জিয়া বললেন, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেকওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স’। অর্থাৎ খুনিদের কৃতকর্ম বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেবেন না। অথচ তার কর্তব্য ছিল অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৯৯৭ সালে মার্কিন সাংবাদিক লরেন লিফশুলজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল রশীদের সাক্ষাৎ হয় ইউরোপে। এ সময় লে. কর্নেল রশীদ লিফশুলজকে আরও জোরালোভাবে বলেন, অবশ্যই রশীদের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ছিল। অন্যদিকে কর্নেল রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদ বলছেন, ‘একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (কর্নেল রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। লরেন লিফশুলজ ২০১১ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পেছনে জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন মূল ছায়াব্যক্তি। যদি তিনি এই অভ্যুত্থানবিরোধী হতেন তা হলে তিনি এই অভ্যুত্থান থামাতে পারতেন। তা করা ছিল তার সাংবিধানিক দায়িত্ব।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র, হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের যোগসূত্র বিবেচনা করে দেখা যায়, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়া সম্পৃক্ত। তাই ইতিহাসের অমোঘ সত্যের পরম্পরায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত রিপোর্টে ষড়যন্ত্রকারী ও মদদদাতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম আসা উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা আসেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে আরও অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যদিও আমাদের দেশের বিদ্যমান আইনে মৃত ব্যক্তির বিচারের সুযোগ নেই, তবুও সম্পূরক তদন্ত রিপোর্ট রেকর্ডে রাখা যেতে পারে।
লেখক: মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
/জেডও