ড. সরকার আবদুল মান্নান
১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির সর্বস্ব হারানোর দিন, নিঃস্ব হওয়ার দিন এবং গভীর শোক আর সন্তাপের দিন। এই দিনে আমরা হারিয়েছি আমাদের পরম প্রিয়জনকে, আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মার আত্মীয়কে, আমাদের ত্রাণকর্তাকে, হাজার বছর ধরে অপেক্ষার পর আবির্ভূত আমাদের আরাধ্য সিংহপুরুষকে। প্রাতঃনমস্ব এই মহাপুরুষের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের জাতির পিতা, অমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু। আমরা হারিয়েছি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। এই মহীয়সী নারী গৃহকোণের অন্তরালে থেকে নিরন্তর জ্বালিয়ে রেখেছিলেন শক্তি আর প্রেরণার আলোকবর্তিকা।
প্রায় তিন যুগের অমানবিক নিপীড়ন-নির্যাতন অতিক্রম করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। জেল-জুলুম আর প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয় অতিক্রম করে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালি তার সব শক্তি নিয়ে জেগে উঠেছিল স্বাধীনতার মন্ত্রে। দক্ষ নাবিকের মতো সব ঝড়ঝাপ্টা, সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বাঙালি জাতি বীরদর্পে এগিয়ে গেছে মুক্তির পথে, স্বাধীনতার সোনালি সূর্যের দিকে। পরিশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পঞ্চান্ন বছরের ছোট এক জীবনকে হাজার বছরের কর্মযজ্ঞে ভরিয়ে তুলেছিলন। যেন সময় ছিল না তাঁর। প্রতিটি মুহূূর্তকে তিনি মহার্ঘ জ্ঞান করতেন। প্রতিটি দিনি, প্রতিটি মাস, প্রতিটি বছর তিনি অতিক্রম করেছেন গুণে গুণে। কত স্বল্প সময়ের মধ্যে, কত দ্রুততার সঙ্গে মুক্ত করা যায় এ দেশের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, হতদরিদ্র মানুষকে। তাঁর না ছিল ঘুম, না ছিল মুহূর্তের জন বিশ্রাম। তিনি একটি স্বপ্নের মধ্যে, একটি দুর্বিনীত আকাক্সক্ষার মধ্যে বসবাস করতেন। সেই স্বপ্ন তাঁকে ঘুমোতে দিত না। সামান্য বিশ্রামের অবসর তাঁর ছিল না। আর সেই স্বপ্ন আর আকাক্সক্ষাটি ছিল : ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’
এ দেশের মানুষকে তিনি মুক্ত করেছিলেন। তিনি এ দেশের মানুষের হাজার বছর ধরে অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন। তিরিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে, অসংখ্য মা-বোনের লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হওয়ার বিনিময়ে পরাধীন এই জাতি মুক্ত হয় এবং লাভ করে চির কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কিংবদন্তিতুল্য নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতার আস্বাদ পাইয়ে দেন। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম এক জাতির-নাম তার বাংলাদেশ।
কিন্তু সেই মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিল ভৌগোলিক বা রাষ্ট্রীয়। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মুক্তি, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী জীবনাচরণের মুক্তি, মানসিক জাড্য ও বন্ধাত্বের মুক্তি তখনও ছিল সুদূরপরাহত। রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য যেমন ওষ্ঠাগতপ্রাণ এক যুদ্ধে নিজেকে নিরন্তর সম্পৃক্ত করেছিলেন, তেমনি এই যুদ্ধেও তিনি এ দেশের প্রতিজন মানুষকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আর সেই যুদ্ধের প্রথম লক্ষ্য ছিল শিক্ষায় মুক্তি। তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার বলে তিনি স্পষ্টতই বুঝেছিলেন যে, শিক্ষাই হচ্ছে সেই অস্ত্র যার মাধ্যমে পরাধীনতার সব নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। তিনি পাশাপাশি তিনি গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠান, যেসব প্রতিষ্ঠান একটি সমৃদ্ধও আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক হবে। মাত্র সাড়ে তিন বছর-দেশীয় ও বহির্বিশ্বের নানা শত্রুর পেছন দিকে টেনে ধরার রাস অতিক্রম করে করে দেশ যখন তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সর্বতোমুখী সমৃদ্ধির দিকে, তখনই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় পৃথিবী থেকে। নির্মম সেই হত্যাযজ্ঞের শিকার হন পরিবার-পরিজন, অত্মীয়-স্বজন এবং রাজনৈতিক সহকর্মীগণ। শেখ রাসেলের মতো নিষ্পাপ শিশু থেকে শুরু করে নববধূ-কেউই রক্ষা পায়নি ঘাতকদের জিঘাংসা থেকে। কারণ হন্তারকরা একটি আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছে। সেই আদর্শ মুক্তিযুদ্ধে আদর্শ; সেই আদর্শ সম্পদের সুষম বণ্টন, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ এবং গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্রভাবনার আদর্শ।
ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে জাতি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বজ্রাহত মানুষের মতো জাতির শিরায় বন্ধ হয়ে যায় রক্তপ্রবাহ। আর স্বাধীন বাংলাদেশকে তারা পরিণত করে শ্মশানে। সেই দুঃসহ ভূতগ্রস্ত সময়ে শুরু হয় ঘাতকদের প্রেতনৃত্য। শ্মশানের সেই মৃত্যুপুরীতে হন্তারকদের প্রেতনৃত্যে শামিল হয় মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রুরা। জন্ম-পরিচয়হীন, পিতা-মাতাহীন, দেশ-দরদিহীন ওই উদ্বাস্তুরা, পরগাছারা আরোহণ করে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির শাসনক্ষমতায়। মর্কট ধারণ করে মুক্তাহার। এভাবে সবকিছু চলে যায় ‘নষ্টদের দখলে’, যা কিছু প্রগতি ও উন্নয়নের পরিপন্থি, যা কিছু মূর্খদের দায়ভার, যা কিছু দুর্গন্ধযুক্ত অবর্জনার স্তূপ তার সবকিছু নিয়ে উলঙ্গ নৃত্যে শামিল হয় এই পিশাচেরা। কী তাদের স্পর্ধা! কী তাদের অশ্লীল দাপট! কী তাদের নির্লজ্জপনা! কিন্তু মিথ্যা ও অসুন্দরের বসতি বেশি দিন হয় না। ঘোর অন্ধকার ভেদ করে একসময় ভোরের সূর্যোদয় ঘটেই এবং তাই হলো।
সেই ঘাতকরা এখন কোথায়? সেই উলঙ্গ নৃত্যপটীয়সী প্রেতের দল এখন কোথায়? কোথায় তাদের হম্বিতম্বি-হুঙ্কার? এই নিকৃষ্টরা, এই নষ্টরা বুঝতেই পারেনি কাকে তারা হত্যা করেছে; কোন অদর্শকে তার নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা করেছে। আর আমরা হারিয়েছি শেখ মুজিবুর রহমানকে, আমাদের পিতাকে। আমরা হারিয়েছি আমাদের জাতীয় জীবনের আলোকবর্তিকা। এই কষ্ট, এই শোক ধারণ করার কি কোনো উপায় আছে! বাঙালি জাতি শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশমাতৃকার উন্নয়নে যে বিচিত্রমুখী ও বিপুল কর্মযজ্ঞে ব্যাপৃত হয়েছে সেখানেই নিহিত আছে চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানোর ভাষা। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের শিকার সবার বিদেহী আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।