বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এমডি থেকে শুরু করে নিম্নস্তরের কর্মচারী যে যেভাবে পারছে জড়িয়ে পড়ছে দুর্নীতিতে। সংস্থাটির পাইলট, কেবিন ক্রু, ফ্লাইট কেটারিং সার্ভিসসহ অগণিত সদস্য স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমান পাওয়ার পরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হচ্ছে না। সাময়িক শাস্তি দিয়ে আবার চাকরিতে বহাল করা হচ্ছে। ফলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনস। ফলে বছরের পর বছর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পাশাপাশি সুনাম তলানিতে এসে ঠেকেছে সংস্থাটির।
হজ পালনরত অবস্থায় চলতি বছরের জুলাই মাসে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সাবেক বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামালকে। জানা গেছে, ১৬ মাস দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম, দুর্নীতি, চার কোটি টাকার বেশি খরচ করে কানাডার টরন্টোতে পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরিতে পুনর্বহাল, পাইলট নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারনে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের তদন্তে মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আশরাফুল আলমকে টিকিট নিয়ে দুর্নীতির প্রধান দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বিমান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু আবু সালেহ মুস্তফা কামাল বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার এক মাসের মাথায় গত বছরের মার্চে আশরাফুলকে দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন, যদিও তার সে এখতিয়ার ছিল না।
বিমানের এ্যাকাউন্টস বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িত থাকার একাধিক প্রমা্ণ পাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।বিমানের ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আবু সায়েদ মো. মঞ্জুর ইমামের বিরুদ্ধেও একাধিক দুর্নীতি প্রমানিত হওয়া পূর্ববর্তী প্রশাসন তাকে অবৈতনিক ছুটিতে পাঠায়। এছাড়া বিমানের ৪০ এর অধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় তাদের অব্যাহতি প্রদান বা চাকরিচ্যুত করা হয়।
কিন্তু বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আবু সালেহ মোস্তফা কামাল দায়িত্ব পাওয়ার পর শাস্তিস্বরূপ স্রেফ ভর্ৎসনা জানিয়ে সকল কর্মকর্তাকে দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন। বিমানের ৪৩ কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছেন, যা গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে তিনি নিজেই স্বীকার করেন। এছাড়া তার সময়কালে বিমানের উড্ডয়ন ও অবতরণের অন-টাইম পারফরম্যান্স ২০১৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মোস্তফা কামালের সময়ে তা কমে ৫৬ শতাংশে নেমে আসে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে মাঝ-আকাশে বিমানের ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজের ইমার্জেন্সি পাওয়ার সিস্টেম চালু করেন এর পাইলট আলী রুবিয়াৎ চৌধুরী। এতে উড়োজাহাজটির দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা মেরামত করতে ১৫ লাখ ডলার খরচ করতে হয় বিমানকে। পাইলটের এসওপি ভঙ্গের কারনে এই ক্ষতি হয়, তদন্তে এমন প্রমান পাওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কোনো কারণ-দর্শানো ছাড়াই সিনিয়র পাইলট ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন মোস্তফা কামাল।এছাড়া মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগের নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে, স্বজনপ্রীতি ও অর্থের বিনিময়ে অনভিজ্ঞ, ক্যাপ্টেন হিসেবে কয়েক বার পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য, পূর্ববর্তী এয়ারলাইন্সে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ও অদক্ষতার কারণে চাকরিচ্যুত, বয়োবৃদ্ধ (৬০ বছরের বেশি), মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ও লাইসেন্সবিহীন আটজন ক্যাপ্টেন ও ছয়জন ফার্স্ট অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করে প্রমাণ পায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এসব কারনে হুট করেই সরিয়ে দেয়া হয় তাকে।
গত জুলাই এর মাঝামাঝিতে মোস্তফা কামালের স্থলাভিষিক্ত হন বিমানের প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক, একই সঙ্গে প্রকিউরমেন্ট ও লজিস্টিক সাপোর্ট এবং মার্কেটিং ও সেলসের অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকা যাহিদ হোসেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহনের এই অল্প সময়ের মধ্যেই ওমরাহ টিকেট ও ঢাকা-গুয়ানজুর টিকেট নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে।
বিমানের সেপ্টেম্বর মাসের ওমরাহ ২২০০ টিকেট ২৮ টি এজেন্সির কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এতে ৭৫ হাজার টাকার টিকেট ১ লাখ ৩৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেটটি। আগে দুর্নীতির দায়ে চাকুরিচ্যুত হবার পর মোস্তফা কামালের সময়ে চাকরি ফিরে পাওয়া বিমানের মহাব্যবস্থাপক (ডিস্ট্রিক সেলস, ঢাকা) আশরাফুল আলম, বিমানের প্রধান কার্যালয়ে বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) শহীদুল হাসানসহ কয়েকজন কর্মকর্তা এই অপকর্মে সাথে জড়িত এমন অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেন নি এমডি যাহিদ হোসেন। উল্টো কোনো অনিয়ম হয় নি বলে সাফাই গেয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া বিমানের ঢাকা গুয়ানজু রুটের টিকেট বিক্রিতে কোনোরকম ঘোষণা ও নির্দেশনা না দেওয়া, অনিয়ম, দুর্নীতি ও বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো এজেন্সিকে সুযোগ না দিয়ে ‘টেক অফ’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে ঢাকা-গুয়াংজু রুটের টিকেট সব টিকেট বিক্রি করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিমান কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)।
অপরদিকে, স্বর্ণ চোরাচলানে বিমানের সদস্যদের জড়িত থাকা নিয়মে পরিনত হয়েছে। দেখা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে কয়েক দিন পর পর কেজি কেজি স্বর্ণসহ কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছেন বেবিচক-বিমানের কর্মীরা। বিমানের পাইলট ও কেবিন ক্রুরাও জড়িয়ে পড়ছেন স্বর্ণ চোরাচালানে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ধরা পড়ছেন তারা। চলতি বছরের গত ১৩ জুন ফ্লাইটে ওঠার আগ মুহূর্তে তিন কোটি টাকার সোনা ও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাসহ সৌদিতে আটক হন বিমানের কেবিন ক্রু ফ্লোরা। এর কিছুদিন আগে সোনাসহ আটক হন আরেক কেবিন ক্রু রুহুল আমিন শুভ।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দাখিল করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বিমানের ২৮ খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। বিমানকে সুশৃঙ্খল এবং যাত্রীসেবা বিশ্বমানের করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে গুরুত্বপূর্ণ ১১টি বিষয় পর্যবেক্ষণের পর প্রতিষ্ঠানটির মান উন্নয়নে ১০টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের স্টাফরা স্বর্ণসহ অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে কার্গো হেলপার, ক্লিনার, বিমান সিকিউরিটি, ক্যাটারিং স্টাফ স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ মিলছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক সময়ের আলোকে জানান, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। যে স্বর্ণ বিমানে আসে, বিমানের বডিতে বা যাত্রী এনে বিমানের কোথাও লুকিয়ে রাখে, সেই স্বর্ণগুলো বের করে নিয়ে আসার সুযোগ শুধু বিমান বা বেবিচকের নির্দিষ্ট কিছু লোকজনের রয়েছে। বাইরের লোকজন এয়ারপোর্টের স্পর্শকাতর জায়গা এপ্রোন সাইডে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর যাত্রী হয়রানিতে বিমানের সুনাম তলানিতে।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম সময়ের আলোকে জানান, বিমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। পাইলট নিয়োগে দুর্নীতির জন্য সাবেক এমডিকে দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছে। যাত্রীসেবা ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই। অন্যান্য এয়ারলাইন্সের তুলনায় বিমান মানসম্পন্ন পূর্ণ সেবা দিতে পারছে না। এ থেকে বিমানকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বিমানের ভেতর এমন জায়গা থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হয় যা সাধারণের জানার কথা নয়। এ থেকে বোঝা যায়, চোরাচালানে বিমানের সদস্যরা জড়িত। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নজরদারি বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিদেশে অবস্থানরত এমডি যাহিদ হোসেনকে ফোন করে পাওয়া যায় নি। সাবেক এমডি আবু সালেহ মোস্তাফা কামলাকে ফোন দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেন নি।