মাত্র ২২ বছর বয়সে ফুটবল ছেড়ে রেফারি হয়ে ম্যাচ পরিচালনা করছেন জয়া চাকমা। এক সময় জাতীয় ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ডালিয়া আক্তার, মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি ফুটবল ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন হ্যান্ডবল খেলা, এরপর কোচিং।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে অল্প বয়সেই ফুটবল ছেড়ে কোচিং, রেফারিং বা অন্য ক্রীড়ায় যোগ দেওয়া নারীদের তালিকা বেশ লম্বা। অম্রাচিং মারমা সাফ ফুটবলেও গোল করেছেন, ২৩ বছর বয়সে ফুটবল ছেড়েছেন। ২৮ বছর বয়সি সাবেক নারী ফুটবলার জয়া চাকমা বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে রেফারির দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি ফুটবল ছেড়েছেন ২০১২ সালে, অর্থাৎ মাত্র ২২ বছর বয়সে।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের ঝরে পড়ার তালিকা বেশ লম্বা। এর কারণ অনেক। নারীদের লিগ হওয়ার কথা থাকলেও তার কোনো ধারাবাহিকতা নেই। যেহেতু খেলা নেই তাই ফুটবলারদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হয়, যেটা শেষ পর্যন্ত ক্লাবগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন শুধু বয়সভিত্তিক ফুটবল দল নিয়ে কাজ করেছে। ফলে গ্রাম থেকে আসা একটা মেয়ের জন্য ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর কোনো পেশাদার মঞ্চ নেই। এ পরিস্থিতিতে একজন খেলোয়াড়ের জন্য ফুটবল চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
ফুটবলারদের ট্রেনিং হয় দিনে চার বেলা, এমন অনুশীলন অনেক ফুটবলার করতে পারেন না, এই কষ্ট সবাই নিতে পারেন না। কারণ ফুটবলারদের যে খাদ্যতালিকা অনুসরণ করা উচিত, আর্থিক কারণে বেশিরভাগ খেলোয়াড়াই তা অনুসরণ করতে পারেন না। শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল নয়, যেসব মেয়ে সাঁতার, অ্যাথলেটিক্সে সুনাম কুড়িয়ে এনে দেশের মুখ আলো করছেন, হয়তো নিজের ঘরে আলো জ্বালাবার সামর্থ্যটুকু তাদের নেই।
আবার অনেক ফুটবলার বিয়ে করে আর ফুটবল চালিয়ে যেতে পারেন না। যেহেতু আমরা বাঙালি, বিয়ে-শাদীর ব্যাপারটা চলে আসে।
শুধু ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বাধার সম্মুখীন। তবে আশার কথা, শত বাধার পরও নারী খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নিয়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারোত্তোলনে সাতটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পদক জয়ী ঢাকার কেরানীগঞ্জের মেয়ে ফাহিমা। বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেটের অলরাউন্ডার পান্না ঘোষ উঠে এসেছেন রাজশাহীর কুমারপাড়া থেকে। নারী-পুরুষের বৈষম্যের বাধা পেরিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। সমাজে কে কী বলল সেদিকে মন না দিয়ে তার সব ভাবনা ক্রিকেট নিয়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে সাবরিনা সুলতানা শুটিং রেঞ্জে রাইফেল হাতে রেঞ্জ থেকে এনেছেন অনেক সাফল্য। সোনার পদকে গৌরবদীপ্ত করেছেন দেশকে। কমনওয়েলথ শুটিংয়ে একটি, সাফে তিনটি, ইন্দো-বাংলায় আটটি সোনা জিতেছেন তিনি।
গিনেস রেকর্ড বুকে নাম ওঠানো বাংলাদেশের টেনিস তারকা জোবেরা রহমান লীনু খোলায়াড় থেকে এখন ক্রীড়া সংগঠক। দাবায় দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রানী হামিদ, বাংলাদেশের দাবার রানি, লিখেছেন দাবাবিষয়ক প্রচুর বই। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সালমা খাতুনের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। পত্রিকায় মেয়েদের ক্রিকেট দল হচ্ছে এমন খবর দেখে মহিলা ক্রিকেটে অংশ নেওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শুরুতে খুলনা দলে ঢুকে চট্টগ্রামের বিপক্ষে অপরাজিত সেঞ্চুরি করেন। এর পর জাতীয় দলে ঢুকে ২০০৮ সালে মালয়েশিয়া সফরের পরই দলের অধিনায়ক হন। সংবাদমাধ্যমে সালমা খেলোয়াড় হিসেবে কিছু প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেন, পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা বছরে অনেক কম ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছেন। তাছাড়া আমাদের নিয়ে ক্যাম্প খুব কম হয়। দলের অনুশীলনও ঠিকমতো হয় না। একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পর যে যার এলাকায় চলে যান। এরপর আর নিয়মিত অনুশীলন হয় না। মহিলা ক্রিকেটের ভালো একটা বুনিয়াদ গড়ে তোলা হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভালো ফল পাবে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশে খেলাধুলার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে শুরুতে নারী খেলোয়াড়দের পদচারণা খুব একটা ভালো ছিল না। যারা শুরুর দিকে এসেছেন তারা নিজস্ব উদ্যোগেই বাংলাদেশের খেলাধুলার জগতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। নিজ উদ্যোগেই মেয়েরা সাফ গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, ইন্দো-বাংলা গেমসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন। সমাজের সব বাধা-বিপত্তি দূরে ঠেলে খেলাকেই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করছেন অনেক মেয়ে। সাফল্য ও উপার্জন ছেলেমেয়ের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে সহায়ক হচ্ছে।
নারীদের খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকেই। এ ছাড়া ধর্মীয় বাধা ও সামাজিক ভ্রুকুটি তো থাকেই। অনেকে মনে করেন, নারীদের খেলাধুলায় অনগ্রসর থাকার একটি প্রধান কারণ পোশাক। পোশাক নিয়ে দেশে কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও বহির্বিশে^র নারীদের মতো পোশাক পরে খেলাধুলায় কিছু মানুষের আপত্তিও দেখা গেছে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেখা গেছে, পোশাকে ধর্মীয় বিধান মেনেই খেলাধুলার জগতে আসছে নারীরা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সৌদি আরব, আফগানিস্তান, ইরানের মেয়েদেরও একই অবস্থা। ধর্মীয় নিয়ম মেনেই ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার বাক্সেটবল, ক্রিকেট এমনকি রাগবিও খেলছে তারা। তুরস্কের মতো মুসলিম দেশে এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়। সৌদি আরবকে সবাই চেনে রক্ষণশীল গোঁড়া দেশ হিসেবে।
সেখানেই এখন মাঠ দাপিয়ে মেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছেন ফুটবল। সৌদি যুবরাজের প্রচেষ্টায় সৌদিতে ফুটবল, বাক্সেটবল, ভলিবল খেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছে বিদ্যালয়ের মেয়েরা। গত অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো নারী ক্রীড়াবিদ প্রেরণ করে ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ইসলামী দেশগুলো, যা অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক। ইরানের মতো কট্টর ইসলামিক দেশের মেয়েরাও এখন রাগবি খেলছে। খেলাটি যথেষ্ট পরিশ্রমের হলেও তারা এটা প্রমাণ করেছে যে, মেয়েরা কঠিন পরিশ্রমের খেলা খেলতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ফিলিস্তিনের নারীরাও এগিয়ে এসেছে ফুটবল খেলতে। হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে দেশটির মেয়েরা পূর্ব জেরুজালেমের ফয়সাল আল হোসাইন স্টেডিয়ামে আরেক মুসলিম দেশ জর্ডানের মেয়েদের সঙ্গে এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচে অংশ নেন।
তবে শুধু ধর্মীয় কট্টর দেশই নয়, পুরুষতান্ত্রিকতাও নারীদের খেলার পথে সৃষ্টি করেছে অনেক বিপত্তি। ১৯৫৪ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জয় করে তখনকার পশ্চিম জার্মানি। গোটা জার্মানিতে তখন উৎসব বয়ে যায়, যাতে অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। সেই সুযোগে দেশটির প্রমীলা ফুটবল জেগে ওঠার চেষ্টা করল। গঠিত হলো জার্মানির প্রথম প্রমীলা ফুটবল দল। কিন্তু মেয়েদের এভাবে মাঠে ছোটাছুটির বিরোধিতা করে বসল জার্মান সমাজ। আর তাদের সঙ্গে গলা মেলাল জার্মান ফুটবল সংস্থাও। জার্মানির ফুটবল সংস্থা থেকে নিষিদ্ধ করা হলো এই প্রমীলা দলকে। এমনকি জার্মান জাতীয় দলের কোচ সেপ হেরবের্গার বলে বসলেন, ‘ফুটবল মেয়েদের জন্য নয়, কারণ এটা পরিশ্রমের ব্যাপার।’ কিন্তু এরপরও দমে যাননি জার্মানির প্রমীলা ফুটবলাররা। ফুটবল মাঠে তারা ছিলেন। কয়েক দশক পর বার্লিনের প্রাচীর পতনের যুগে জার্মান সমাজ যখন নতুন করে পথ দেখছে, তখন প্রমীলা ফুটবলাররাও দুর্দান্ত এক সাফল্য নিয়ে এলো। সবাইকে চমকে দিয়ে ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হলো জার্মানির প্রমীলা ফুটবল দল। জার্মান নারীদের এই সাফল্য সত্যিই ছিল এক অভাবনীয় ব্যাপার। তাদের অভিনন্দন জানাতে তৎপর হয়ে উঠল জার্মান ফুটবল সংস্থা।
২০১৮ সালে বছরের ৮ মার্চ শুরু হয় নাগেশ্বরী উপজেলার কলেজ মাঠে রোমানা স্পোর্টিং ক্লাবের আয়োজনে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই খেলা বন্ধের দাবিতে ১৪ মার্চ বিক্ষোভ করে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেয় একদল স্থানীয় মানুষ। কুড়িগ্রামে মেয়েদের ফুটবলের বিরোধিতা করে মিছিল বের করেছিল তারা। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নারী ফুটবলের আজকের সাফল্য নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চাইছেন না। বরং সেই ছবি সামনে আনায় ভীষণ রাগ তাদের। ফলে দেখা যাচ্ছে, এসব বাধা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে সাফল্য।
বর্তমানে যেটি জরুরি সেটি হচ্ছে মিডিয়ার সমর্থন। গণমাধ্যম নারীদের খেলাধুলার জগতে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা যেভাবে কোনো বিষয় উপস্থাপন করবে সেভাবে দেশের জনগণ গ্রহণ করবে। জনগণকে সচেতন করতে এবং নারীদের খেলাধুলায় অনুপ্রেরণা দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে দেখা যায়, নির্দিষ্ট কিছু খেলার ওপর সংবাদ প্রচারে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ক্রিকেট, ফুটবল ছাড়াও যে দেশে আরও খেলা আছে সেগুলোর কোনো খবর গণমাধ্যমে আসে না। ফলে মেয়েরা বিভিন্ন খেলা সম্পর্কে কোনো খবর জানেন না এবং সে সবের প্রতি কোনো আগ্রহও দেখান না। খেলাধুলার উন্নয়নে ক্রীড়াশিক্ষাকে পাঠ্যপুস্তকে আবশ্যকীয় করা উচিত। এটি করা হলে অন্যান্য বিষয়ের মতো এ বিষয়েও শিক্ষার্থীরা দায় অনুভব করবে। এতে ছেলেমেয়ে উভয়েরই বিভিন্ন খেলার সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর ২১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে দেশে অবতরণ করে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। বিমানবন্দর এলাকা আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়। সকাল থেকেই আসতে শুরু করে দেশের ফুটবল-সমর্থকরা। বিমানবন্দর এলাকা স্লোগান মুখর। হাজারো সমর্থকে সয়লাব বিমানবন্দর এলাকা। অনেক সংবাদকর্মী ও ক্যামেরার ভিড়। সাম্প্র্রতিককালে কোনো ইভেন্ট কাভার করতে এত সংবাদকর্মী বিমানবন্দরে এসেছেন কি না কেউ মনে করতে পারছেন না।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে সবার চোখেমুখে একটি অদৃশ্য ছবি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, আনন্দ! ফুটবল মাঠে দক্ষিণ এশিয়া জয় করা মেয়েদের বরণ করে নিতে গতকাল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না! সারা দেশের মানুষ অপেক্ষা করছে তাদের অভিবাদন জানানোর জন্য। সাফ জয়ী বীরকন্যারা আমাদের ভাবনার আকাশ অনেক বদলে দিয়েছে। আজ আমাদের আকাশ জুড়ে আলো। লাখো মেয়ের আকাশ এখন অনেক বড়। তারা এখন আকাশ সমান স্বপ্ন দেখতে সাহস পাবে। এমন আনন্দ বার বার ফিরে আসুক। বাংলাদেশের অদম্য নারীরা এভাবেই বিশে^র দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে যাবে-এমনটাই মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক