বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান। বিভিন্নভাবে সময়ে খবরের শিরোনাম হয়ে থাকেন তিনি। এবার সংবাদ মাধ্যমে এসেছেন শেয়ার কারসাজির খবরে। দেশের পুঁজিবাজারে সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ।
এর ফলে গতকাল পুঁজিবাজারে বড় পতন হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী ও বিশেষজ্ঞরা। টানা দুই দিন পতনের পর মঙ্গলবার ঘুরে দাঁড়ায় দেশের পুঁজিবাজার। কিন্তু এদিন বিকালেই দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সাকিবের শেয়ার কারসাজি সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ পায়। শেয়ার কারসাজির জন্য আলোচিত বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরোর বাবা, স্ত্রী, শ্যালক এবং বোনকে জরিমানা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। যেসব শেয়ারের নাম এসেছে তালিকায় সেসব শেয়ারের বেচাকেনায় ভাটা পড়ে গতকাল। এর প্রভাব পড়ে অন্যান্য শেয়ারেও। এ কারণে ৫০ পয়েন্টের বিশাল পতন হয় পুঁজিবাজারে বলে জানান সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
অন্যদিকে দেশের পুঁজিবাজারসহ বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের শুভেচ্ছাদূত বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
সাইফুল ইসলাম নামে এক সাধারণ বিনিয়োগকারী সময়ের আলোকে বলেন, ‘সাকিব আমার খুব প্রিয় খেলোয়াড়। বাংলাদেশ দলের মধ্যে একমাত্র ওকেই আমার ভালো লাগে। সেও যদি শেয়ার কারসাজি করে তবে এ মার্কেটের ব্যাপারে একটু সাবধান তো হতেই হয়। যে শেয়ারের নাম এসেছে সেগুলো আমিও কিনেছিলাম। তা আজ (গতকাল) বিক্রি করে দিয়েছি। আমার মতো এমন আরও অনেক মানুষই আছে।’
আসাদ নূর নামের একজন বলেন, ‘বিএসইসি এখন এদের জরিমানা করছে। অথচ বাজার কিন্তু নষ্ট হয়েছে আরও আগে। বাজার খারাপ করার সময়ের ঘটনায় তাদের জরিমানা করছে। তার মানে, বাজার যখন খারাপ হয় তখন কারসাজি হয়। তখন বিএসইসি কেন তাদের ধরতে পারে না?’
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি দেশেই কারসাজি হয় শেয়ারবাজারে। এটি ধরার দায়িত্ব কমিশনের। আমাদের দেশেও হয়। এর আগে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে বড় কারসাজির ঘটনা ঘটে। সেসব ঘটনায় কোনো শাস্তি হয়নি। তাই কারসাজিকারীরা নির্ভয়ে কাজ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাকিবের ঘটনায় বাজার খারাপ হয়েছে এটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও কিছু তো সত্য। কেননা সাকিব অনেক মানুষের প্রিয় খেলোয়াড়। অনেকে তাকে দেখে শেয়ার কেনে। এ ঘটনায় বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে এবং পড়বে এটা বুঝতে তো বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের তদন্তে বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। এরা কারসাজিতে জড়িত। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখানে কে ক্রিকেটার কিংবা কে সেলিব্রিটি তা আমরা গণ্য করছি না।’
বাজারে পতনের বিষয়ে বিএসইসির এক কমিশনার বলেন, ‘সাকিব দেশের একজন বড় মাপের নাগরিক। সাকিব সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ই দেশে প্রভাব ফেলে। এখানেও যে পড়েনি তা তো বলতে পারব না। পড়তেও পারে। তবে এ অবস্থা কেটে যাবে।’
এদিকে সাকিবের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর বুধবার পুঁজিবাজারে পতন হয় ৫০ পয়েন্টের। এদিন সবগুলো সূচকেরই পতন হয়। লেনদেনও কমে আগের কার্যদিবসের তুলনায়। এদিন লেনদেন হয় ১ হাজার ৩০৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকার, যা আগের দিন থেকে ১৭২ কোটি ২৯ লাখ টাকা কম। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪৮০ কোটি ৭ লাখ টাকার।
এদিকে বিএসইসি বলেছে, শেয়ার কারসাজিতে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় সাকিবের প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে। তবে শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকায় বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারীসহ প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়েছে।
কমিশনের মতে, তদন্ত কার্যক্রমে সাকিবের প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু কারসাজিকারীর সঙ্গে তার যোগসাজশ পাওয়া যায়নি। তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার সময় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য অনেককেই সন্দেহের তালিকায় নেওয়া হয়। কিন্তু তাদের সবাই যে কারসাজিতে জড়িত থাকবেন, এমনটি নয়। একাধিক যাচাই-বাছাই করে, প্রকৃতপক্ষে যারা শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত; তাদের চিহ্নিত করে জরিমানা করা হয়েছে। আর অন্যদের এই তদন্ত কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। শেয়ার কারসাজির সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এ জন্য তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সাকিব আল হাসান শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে কারসাজিতেও জড়িয়ে পড়েছেন-এমন খবরে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সমালোচকরা শুভেচ্ছাদূতের এমন কর্মকাণ্ডে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশ করেছেন। অনেকেই করছেন বাজে মন্তব্য। মূলত বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাকিবকে নিয়ে ‘মনগড়া ও অসত্য খবর’ প্রকাশিত হওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করে বিএসইসি।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে তো অনেকেরই নাম থাকে কিন্তু সবাই কি অভিযুক্ত? তদন্ত প্রতিবেদনে সাকিব আল হাসানের নামে কোনো সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন প্রমাণিত হয়নি। তাই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাকে এ বিষয়ে কোনো সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়নি।’ তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাকিবের শেয়ার কারসাজি নিয়ে যেসব খবর প্রকাশ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয় বলেও নিশ্চিত করেন মোহাম্মদ রেজাউল করিম।