মো. সৈয়দুর রহমান
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা। বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীর জলবায়ু প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন যেমন একদিকে ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে সহায়-সম্বল হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দুর্যোগকবলিত এলাকার মানুষ। বৈশি^ক জলবায়ু ঝুঁকিসূচক অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম দিকে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি। পাশাপাশি দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের অন্যতম অবলম্বন এই কৃষি খাত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে তারতম্য ঘটছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ফসলের উৎপাদনশীলতার ওপর। একই সঙ্গে কমে যাচ্ছে জমির উর্বরতাশক্তি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিগত ৫০ বছরে অন্তত ২০ বার দেশ খরার ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং তীব্রতাভেদে আমনসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন ২০-৬০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়ে প্রচুর উৎপাদনশীল জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি কৃষিজমিতে ঢুকে পড়ার কারণে কৃষিজমির লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততাকবলিত। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, শুধু লবণাক্ততার কারণেই প্রতি বছর উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৩০ লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ভবিষ্যতে খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় এখন থেকেই দুর্যোগসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। অন্যথায় খাদ্যদ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মকালে দেশে সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব বলছে, গত ১০০ বছরে দেশের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের জীবন ও জীবিকার ওপর। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুর। অতি-উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করে কৃষক ও শ্রমিকদের শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রচণ্ড গরমে অল্পক্ষণ কাজ করেই তারা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফলে উৎপাদনক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে শ্রমঘণ্টা। সম্প্রতি বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনসের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে নষ্ট হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রমঘণ্টা।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন কোনো ঋতুই সময়মতো আসছে না। গ্রীষ্মকাল অনেক বেশি দীর্ঘতর ও উষ্ণতর হচ্ছে এবং শীতকাল আরও উষ্ণতর হয়ে উঠছে, যার ফলে শীতকালেও বৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তিত আবহাওয়া ও ঋতু আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত গরমে বেড়েছে হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শ্বাসতন্ত্র এবং পানি ও মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালের ডেঙ্গু মহামারি ও বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেকটাই আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণের প্রভাব। উষ্ণতা, আর্দ্রতা ও বায়ুদূষণ বৃদ্ধির ফলে ত্বক, ফুসফুস, পাকস্থলী, কিডনিসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অতিমাত্রায় কার্বন নির্গমন শিশুদের ভবিষ্যৎ হুমকিতে ফেলছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে এক কোটি ৯০ লাখেরও বেশি শিশুর জীবন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সরাসরি ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশুদের মধ্যে পানি ও বায়ুবাহিত রোগব্যাধি, অপুষ্টি, দুর্যোগকালীন মৃত্যু ও আঘাতের হার বাড়ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধিতে শিশুদের টনসিলের প্রদাহ, কানের সমস্যা, ঘন ঘন সর্দি-কাশি, রোটা ভাইরাসের কারণে মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতিতে গর্ভবতী মা ও নবজাতকের বিভিন্ন জটিলতা বহুগুণ বেড়ে যায়। শিশু বিকলাঙ্গ হওয়া, গর্ভাবস্থায় শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়াসহ নবজাতকের নানা রকম সমস্যা বাড়ছে।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে নিরাপদ পানির তীব্র সঙ্কট। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুকুর ও খালে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ার কারণে উপকূলীয় এলাকায় মিঠাপানির প্রাপ্যতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতেও পানি সঙ্কটের পাশাপাশি রয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৪ শতাংশ মানুষ খাওয়ার জন্য নিরাপদ পানি পায় না। অনাবৃষ্টির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অতি দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। সরকারি হিসাব মতেই সারা দেশের নানা জায়গায় পানির স্তর ৪ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত কমে গেছে।
দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নানা রকম প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে বাংলাদেশে। অনেক প্রজাতিই হারিয়ে যেতে বসেছে। গাছ, মাছ, পাখি, ফুল, ফল-সবকিছুতেই এই প্রভাব লক্ষণীয়। ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদনের তথ্য মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের শতকরা ৭৫ ভাগ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। জোয়ারের প্রভাব ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছে ব্যাপক মাত্রায় আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে। মিঠাপানির অভাবে মায়া হরিণসহ অন্য জীবজন্তুর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।
ভূমণ্ডলীয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের সমাজব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নদীভাঙন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। সরকার বলছে, বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ এরই মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর বিশ্বব্যাংকের হিসাব জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে। এই সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু। এসব আশ্রয়হীন উদ্বাস্তু আশ্রয় নিচ্ছে নিকটবর্তী বড় শহরগুলোতে কিংবা রাজধানী ঢাকায়। এতে একদিকে যেমন শহরের ওপর চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে গড়ে উঠছে বস্তি এলাকা। শহরে কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে এবং টাকার অভাবে এরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক ও অসামাজিক কার্যকলাপে। এ ছাড়া বস্তি এলাকার বেশিরভাগ শিশু-কিশোর অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে এবং সমাজে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তার অভাব।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা, খরাসহ সব দিক দিয়েই বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর তীব্রতা অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে আশঙ্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিরাট অংশ নিরাপদ পানির তীব্র সঙ্কটে পতিত হবে। উৎপাদনশীলতা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকলে আমদানি খরচ বাড়বে ও রফতানি কমবে এবং এর প্রভাব পড়বে দেশের রিজার্ভের ওপর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে দেশের মোট জিডিপির ক্ষতি হয়েছে ১.৩২ শতাংশ, টাকার হিসাবে যা এক লাখ ৭৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার সমমূল্যের সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। তাই জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় এখন থেকেই সরকার ও জনগণকে সচেতন হতে হবে।
বেশি বেশি বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি জলবায়ুবান্ধব কর্মসূচি উদ্ভাবন ও সমাধান খুঁজে বের করার জন্য গবেষণায় মনোনিবেশ করার কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। কার্বন-ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের হার কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রস্তুত ও তা কার্যকরের উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা আমাদের সবার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ