
প্রযুক্তি এখন সর্বগ্রাসী নয়, সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে। আমাদের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি আগেও ছিল, মানুষ তা ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই সময় এসে প্রযুক্তির ব্যবহার বহু দিক থেকে বিস্তৃত হয়েছে, প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কোথায় না প্রযুক্তি!
ইন্টারনেটনির্ভর সামাজিক মাধ্যম, ইউটিউব ও সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে মানুষের মতামত প্রদান ও তথ্য আদান-প্রদান খুব সহজ হয়ে উঠেছে। বই এখন কাগজে ছাপা না হয়ে ই-ভার্সনে প্রকাশ হচ্ছে, এতে নতুন প্রজন্মসহ অন্যান্য বয়সের পাঠকও সহজে বই পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। কাগজের বই একসঙ্গে একখানে অনেক রাখা, বহুদিন ধরে সংরক্ষণ করা, প্রয়োজনের সময়ে বই দূরবর্তী অবস্থান থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, কষ্টকর হয়। এমন পরিস্থিতিতে ই-বুক শুধু জনপ্রিয় হচ্ছে না, তা বিভিন্ন কারণে ও সুবিধার কারণে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
বিশ্বের বড় বড় লাইব্রেরি ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা দিচ্ছে, পুরনো সব বই ই-ফর্মে রূপান্তরিত করে সংরক্ষণ করছে, পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। যে কাগজের বই শিক্ষার এক মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়ে বিষয়-তথ্য ও জ্ঞান ছাত্রদের কাছে পৌঁছে যেত, সেই কাগজের বইয়ের বিষয় আজ বিভিন্ন রকমের আকর্ষণীয় অলঙ্করণ, ভিডিও ইফেক্টস, ছবি, রং দিয়ে আরও অনেকগুণ আকর্ষণীয় হয়ে শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ফর্মে, প্রযুক্তির কল্যাণে। এই বাস্তবতা আমাদের গ্রহণ করতেই হবে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে।
জ্ঞানচর্চার জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। নানা বিষয়ের বই পড়ার জন্য লাইব্রেরির চেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে? আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে নিজেকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি দুনিয়ার বিবিধ খোঁজখবরও রাখা জরুরি ও প্রয়োজনীয়। মুহূর্তেই বিশ্বের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে এখন ব্যবহার হচ্ছে ‘ই-লাইব্রেরি’।
ই-লাইব্রেরি হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত এমন এক আয়োজন, যেখানে মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক বই বা ই-বুক পড়ার সুযোগ রয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দুনিয়ার যেকোনো জায়গার নির্দিষ্ট লাইব্রেরি বা প্রকাশকের ডেটাবেইজে যুক্ত হয়ে ডিজিটাল প্রকাশনা পাওয়া যাচ্ছে।
অনলাইনে পড়া যাচ্ছে বহু মূল্যবান বই, আবার কম্পিউটারে নামিয়ে নিয়েও পড়া যাচ্ছে। ফলে তা সহজ হচ্ছে, বেঁচে যাচ্ছে অর্থ, সময় ও স্থানের দূরত্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়সহ আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগ ই-লাইব্রেরি সীমিতভাবে চালু করেছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ই-লাইব্রেরির সেবা দিতে এগিয়ে এসেছে। জাতীয় গ্রন্থাগার, বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার এ পক্ষত্রে আশাজাগানিয়া ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শ্রেণির বই অনলাইনে প্রকাশ করেছে। ইন্টারনেট থেকে যেকোনো সময় যে কেউ প্রয়োজনীয় বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে।
‘সেই বই ডট কম’-বাংলা বইয়ের একটি অনলাইন ই-বুক লাইব্রেরি চালু করেছে। স্মার্টফোন বা ট্যাবে পড়ার উপযোগী ফ্রি এবং স্বল্পমূল্যের ই-বুকের এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে ‘সেই বই ডট কমে’।
এ ছাড়া ‘বইয়ের ঠিকানা’, ‘গ্রন্থ.কম’, ‘গুডরিডস’, ‘বইয়ের দোকান’, ‘ই-বুক রিড’, ‘সোভিয়েট বইয়ের অনুবাদ’, ‘অনলাইন বুক পেইজ’সহ আরও বেশ কিছু ই-লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সহায়ক ইংরেজি ভাষায় নানা বিষয়ের ৩৫ হাজারের বেশি বই দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘অনলাইন বুক পেইজ’ নামের একটি ওয়েবসাইট। নিবন্ধন ছাড়াই যে কেউ এই ওয়েবসাইট থেকে বই সংগ্রহ করতে পারবেন বিনামূল্যে। এ ছাড়া আরও শিক্ষাবিষয়ক বই নিয়ে ই-লাইব্রেরি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে।
বর্তমানে হাতের নাগালে চলে এসেছে তথ্যপ্রযুক্তি, এর বহুমাত্রিক ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। বই তো আর কেবল কাগজে ছাপা, বাঁধানো মলাটে সীমাবদ্ধ হয়ে আজ নেই। কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক বা ই-বুক বা ডিজিটাল ভার্সনে বই পড়ার পাঠকসংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে ই-বুক এখন বেশ জনপ্রিয়। আমাদের দেশে ল্যাপটপ, ট্যাবলেট কম্পিউটার, ই-বুক রিডার এবং সাম্প্রতিক সময়ের মোবাইল ফোনসেটগুলো ইলেকট্রনিক বই পড়াটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এমন বইয়ের সঙ্গে পরিচিত এখন অনেকেই। কম্পিউটারে, ল্যাপটপে তো বই পড়া যায়ই, আবার বই পড়ার জন্য ট্যাব অথবা ই-বুক রিডারেরও ব্যবহার হচ্ছে। কাগজের বই অপেক্ষা দামে সস্তা ই-বুক। কয়েক হাজার ই-বুক ছোট একটি ডিভাইসে সংরক্ষণ করা যায় বলে কাগজের বই অপেক্ষা অনেক হালকা, সর্বস্তরের পড়ুয়া বিশেষ করে ছাত্র এবং ভ্রমণকারীদের জন্য সুবিধাজনকও।
ডিজিটাল বিশ্বে ই-বুক একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ই-বুক ধারণাটি শুধু বইকে সহজলভ্য করে তোলেনি, বইকে জনপ্রিয়ও করে তুলেছে। ই-বুকের উত্থানের ফলে পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। ই-বুকের এ বিপুল সম্ভারে বাংলা বই কাক্সিক্ষতভাবে নেই বললেই চলে। ডিজিটাল বিশ্বে বাংলা বইয়ের অবস্থান বাড়াতে সরকারের ও সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে আরও। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হলে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর ই-সংস্করণ অনলাইনে আমরা সহজে পেতে পারি। দেশের সমৃদ্ধ লাইব্রেরির মূল্যবান গ্রন্থগুলোকেও পাঠকের কাছে সহজলভ্য করার পদক্ষেপ নেওয়াটা এখন জরুরি। একটি বইনির্ভর ও পাঠাভ্যাসে অভ্যস্ত নয়া প্রজন্ম সৃষ্টিতে এমন উদ্যোগ শুধু পরিপূরক নয়, গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাভাষীরা অনায়াসে তাদের পছন্দের গ্রন্থ যেন পাঠ করতে পারে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু নয়, জাতীয় আর্কাইভসও তাদের সংগৃহীত দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর ই-বুক ও ই-লাইব্রেরি তৈরি করে বাংলাভাষী পাঠককে জ্ঞানের জগতে পৌঁছে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
নতুন প্রজন্ম কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে। কাগজের বই হয়তো আমাদের দেশে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে আরও বেশি আয়ু লাভ করলেও, তা হয়তো একসময়ে সঙ্কুচিত হবে। আজ যেমন কাগজে মুদ্রিত দৈনিকের দিন ছোট হয়ে আসছে, কাগজের দৈনিক বন্ধ হচ্ছে, অনেক উন্নত দেশে ই-ভার্সনে দৈনিক বের হচ্ছে। আমাদের দেশের সব জাতীয় দৈনিকের ই-ভার্সন রয়েছে বলেই যখন ইচ্ছে তখনই পৃথিবীর যেকোনো দেশে অবস্থান করেই দেশের দৈনিক পড়তে পারছি।
অন্যদিকে আজ অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা বহুবিধ সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। দৈনিকের সাহিত্য পাতা বা পত্রিকাও তাদের ওয়েব-ভার্সন রাখছে। সে কারণে একধরনের প্রতিযোগিতা থাকছেই। অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ তৈরি করার সুযোগ সহজ হওয়ায়, এমন মাধ্যম জনপ্রিয়ও হচ্ছে। এর কারণ বহুবিধ। মানুষ প্রযুক্তির সুযোগ পেয়ে সহজে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে তা পড়তে পারেন সহজে, এর অলঙ্করণ ও ছাপা লিটলম্যাগের চেয়ে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব হচ্ছে, দ্রুত তা প্রকাশ করাও সম্ভব হয়, লেখা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করা যায়। ধীরে ধীরে কাগজে ছাপা লিটলম্যাগের জায়গাটা অনেকটা অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ দখল করছে, তা ভবিষ্যতে আরও দখল করতে পারে। আমরা জানি ইতোমধ্যে কাগজে ছাপা পত্রিকা ও সাময়িকী বিভিন্ন দেশে বন্ধ হয়ে গেছে। এই অভিঘাত নতুনের আহ্বান তৈরি করছে, তা তো আর রোধ করা যাবে না পুরোপুরি! তবে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা সার্কুলেশনে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে, তবে বিভিন্নভাবে গ্রহণযোগ্য করার ওপরই তার আরও সফলতা নির্ভর করে।
অনেকের সঙ্গে আমি একমত নই যে, আজকের প্রজন্ম, আজকের তরুণেরা, আজকের লোকেরা পড়াশোনা কম করছে! তারা হয়তো কাগজের বই কম পড়ছে। কিন্তু বিষয়-তথ্য-তত্ত্ব ও অন্য বিভিন্নমুখী জ্ঞান আজ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ফর্মে ধারণ করা হয়ে থাকে, যা অবারিত ইন্টারনেটের দুনিয়ায়, তা থেকে তারা কাগজে ছাপানো বইয়ের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে সহজেই। এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আজকের শিশু-কিশোররা যে বিচিত্রমুখী জ্ঞানময়-এলাকা দখল করতে পারছে সহজে, তা ১০-২০ বছর আগে সম্ভব ছিল না। এই কালের, এই বাস্তবতাকে আমাদের আরও পজিটিভভাবে দেখতে হবে, ব্যবহার করতে হবে এবং এই চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।