সুবোধ ঘোষের জন্ম ১৯০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। তার আদি নিবাস অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে। হাজারীবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। বিচিত্র জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল তার জীবন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে।
এ ছাড়াও টিউশন, ট্রাক ড্রাইভার, সার্কাস পার্টিতে ক্লাউনের ভূমিকায় ছিলেন। বহু পথ ঘুরে ত্রিশের দশকের শেষে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। এরপর সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর এবং অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক হয়েছিলেন।
সমালোচকরা বলেছেন, বাংলা ছোটগল্পের গর্ব সুবোধ ঘোষ। বহু বিচিত্র চরিত্র ও অভিজ্ঞতার কোমল-মায়াময়-হৃদয়গ্রাহী গল্প লিখতেন তিনি। গল্পকে গল্প করে বলা, সেই সঙ্গে শিল্পের স্বচ্ছতম গুণটিকে ধরে রাখা-এই অনায়াস সিদ্ধিতে সুবোধ ঘোষ কথার জাদুকর। ফলে বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে সুবোধ ঘোষের আসনটি সুচিহ্নিত।
সুবোধ ঘোষের গল্পকার হয়ে ওঠার পেছনে একটি গল্প সর্বজন স্বীকৃত। যখন ‘আনন্দবাজারে’র কয়েকজন কর্মী লেখক ‘অনামী সঙ্গ’ নামে একটি সমাবেশ গড়ে তুলেছিলেন তাতে ছিলেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, বিনয় ঘোষ, মন্মথ নাথ সান্যাল প্রমুখ। তারা প্রতি মাসের দুই রোববার এক বন্ধুর বাড়িতে সমবেত হয়ে সাহিত্যের আলোচনা এবং নিজের লেখা পাঠ করতেন। সেই লেখার ভালো-মন্দ গুণের বিচার করা হতো। তাদেরই ইচ্ছা ও অনুরোধে সুবোধ ঘোষ গল্প লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জানা যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের কড়া অনুরোধেই তিনি পরবর্তী দুই বৈঠকে নিজের লেখা দুটি গল্প পড়েন। গল্প দুটি হচ্ছে-‘অযান্ত্রিক’ ও ‘ফসিল’। এই দুটি গল্প লিখেই সুবোধ ঘোষ রাতারাতি বিখ্যাত হন। প্রথম গল্প ‘অযান্ত্রিক’ প্রকাশ হয়েছিল ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যায়। ‘ফসিল’ গল্পটি প্রকাশ হয়েছিল ‘অগ্রণী’ নামের একটি মাসিক পত্রিকায়। ‘ফসিল’ গল্প প্রকাশ হওয়ার পর পাঠকের প্রশংসা শোনা গেল চারদিকে। সুবোধ ঘোষের গল্পের বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, প্রকাশভঙ্গির বলিষ্ঠতা, শানিত দৃষ্টিভঙ্গি, চল্লিশের সূচনাতেই বিরাট সাড়া জাগাল। তার প্রথম গল্প অযান্ত্রিকের নায়ক একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। সে ভালোবাসে তার বহুদিনের জীর্ণ-পুরনো সেকেলে মোটর গাড়িকে। এই গাড়িই তার জীবনসঙ্গী। তার সেই ভালোবাসা যেমন প্রচণ্ড, তেমনই তার বিরাগও ক্ষমাহীন। যে গাড়ি সম্পর্কে কারও বিরূপ মন্তব্য তার অসহ্য ছিল, সে গাড়িকেই একদিন সে ওজনদরে লোহা ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিল। কোমলে-কঠিনে এক অদ্ভুত গল্প। কিন্তু তার চেয়েও তার দ্বিতীয় গল্প ‘ফসিল’ বাংলা সাহিত্যের এক ল্যান্ডমার্ক।
চল্লিশের দশকের আগে সাধারণভাবে প্রেমচর্চাই ছিল প্রধান। কিন্তু চল্লিশের দশকে প্রধান হয়ে উঠল রাজনীতিচর্চা। বিশ্ব মহাসমর এবং তার আনুষঙ্গিকের ধাক্কায় দ্রুত সংগঠিত হচ্ছিল সমাজের ভাঙন, ফলে মনোরাজ্যেও দেখা দিল আদর্শ সংঘাত। চিন্তার ঘূর্ণিপাকে অনেকটা কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে। সুবোধ ঘোষের মধ্যে আছে তারই সার্থক রূপায়ণ।
সুবোধ ঘোষের বহু গল্প আলোচনা করে দেখা যায়, সমাজসচেতন সৃষ্টি হিসেবে সেগুলো উল্লেখযোগ্য। তিনি বহু গল্প লিখেছেন। তার গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। ‘ফসিল’, ‘পরশুরামের কুঠার’, ‘জতুগৃহ’, ‘পুতুলের চিঠি’, ‘মনভ্রমরা’, ‘ভোরের মালতী’, ‘মণিকর্ণিকা’, ‘অর্কিড’, ‘সায়ন্তনী’, ‘নিকষিত হেম’, ‘রূপনগর’, ‘পলাশের নেশা’, ‘গ্রাম যমুনা’, নানা গল্পসংগ্রহ ইত্যাদি। তার যাবতীয় গল্প নিয়ে সুবোধ ঘোষের গল্পসমগ্রও প্রকাশ করা হয়েছে। তিন খণ্ডে প্রকাশিত এ সমগ্রে দেড় শতাধিক গল্প স্থান পেয়েছে। তাই এককথায় বলা যায়, সুবোধ ঘোষ বাংলা ছোটগল্পে উল্লেখযোগ্য অবদানের অধিকারী।
জীবনকে তিনি বিচিত্রভাবে উপলব্ধি করেছেন। সেই উপলব্ধি তার গল্পেও ফুটিয়ে তুলেছেন। সাংবাদিক কৌতূহলে আমাদের পরিচিত জীবনের নানা সংবাদ তার গল্পে ভাষ্যরূপ লাভ করেছে। ফলে বাংলা সাহিত্যের বিষয়বিন্যাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছিল।