মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ করে প্রয়োজনীয় এই ডিভাইসটি যদি হারিয়ে যায় বিপদে পড়তে হয় সবাইকে। অসংখ্য কনটাক্ট, মেসেজ, তথ্য, ছবি, ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট সবকিছু হারিয়ে যায়। অনেকের কাছে বিষয়টি হাতের মুঠো থেকে পৃথিবী হারিয়ে যাওয়ার মতো। এই হারিয়ে যাওয়া মোবাইল খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে পড়ি আমরা। কিন্তু কীভাবে ফিরে পাবেন হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়া মোবাইল?
জিডি করার মাধ্যমে হারানো মোবাইল খুঁজে পাওয়া
অনেকেই মনে করেন জিডি করাটা বেশ ঝামেলাদায়ক এবং এতে কোনো লাভ নেই। বিষয়টি একেবারেই তা নয়। যদি আপনার মোবাইল ফোন হারিয়ে বা চুরি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে প্রথম কাজই হলো জিডি করা। মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে থানায় জিডি করার মাধ্যমে আপনি পুরো ব্যাপারটিকে নথিভুক্ত করছেন। পরবর্তী সময়ে কোনোভাবে মোবাইলটি ফেরত পেলে সেটি যে আপনারই তা প্রমাণ করতে জিডির কপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই সবার আগে জিডি করুন। এ ক্ষেত্রে যেখান থেকে মোবাইল হারাবে সেখানকার থানাতেই জিডি করতে হবে। পুলিশি সহায়তা পেলে হারানো মোবাইল খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে বেড়ে যায়।
এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, জিডি করার ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো অর্থ প্রদানের প্রয়োজন হয় না। সেই সঙ্গে আপনার মোবাইলের মডেল এবং সম্ভব হলে ইএমআই নম্বরসহ জিডি করতে হবে। মনে রাখা উচিত, শুধু হারানো ফোন ফেরত পাওয়া নয়, বরং আপনার ফোন দিয়ে অবৈধ কোনো কার্যক্রম হলেও এই জিডি আপনাকে রক্ষা করবে ভবিষ্যৎ আইনি জটিলতা এড়াতে।
গুগলের ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ ব্যবহার
যদি আপনি ডিজিটালি আপনার ঘরে বসেই হারানো মোবাইলটিকে খুঁজে পেতে চান তাহলে এটিই আপনার জন্য সেরা উপায়। গুগল ফাইন্ড মাই ডিভাইস ফিচারটি প্রত্যেকটি অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসেই রয়েছে। যেকোনো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে আপনাকে একটি গুগল অ্যাকাউন্ট দিয়ে সাইন ইন করতেই হয়। গুগল অ্যাকাউন্ট দিয়ে সাইন ইন করার সঙ্গে সঙ্গেই ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ ফিচারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়।
‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ ফিচারটি যদিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়, তবুও চালু আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া ভালো। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে প্রথমেই চলে যান আপনার মোবাইলের সেটিংস অপশনে। সেখানে একটু স্ক্রল করলেই গুগল নামক অপশন পাবেন। অনেক ক্ষেত্রে গুগুল অপশনটি অ্যাকাউন্ট/মাই অ্যাকাউন্টস অপশনের ভেতরেও থাকে। গুগল অপশনে ঢুকে ‘সার্ভিসেস অন দিস ডিভাইস’ সেকশনটি পাবেন। সেখান থেকে ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ অপশনটি খুঁজে পাবেন। তাতে ট্যাপ করলেই একটি স্ক্রিন ভেসে উঠবে। এতে সার্ভিসটি চালু আছে কি না তা বুঝতে পারবেন এবং কী কী উপায়ে আপনার মোবাইলটি খুঁজে পাওয়া যাবে তা দেখতে পারবেন।
‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ সেবাটি যেকোনো প্ল্যাটফর্ম থেকেই ব্যবহার করা যায়। আপনি চাইলে আরেকটি মোবাইল ফোনে ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ অ্যাপ নামিয়ে নিতে পারেন। অথবা ফোনের ব্রাউজার কিংবা কম্পিউটারের ব্রাউজার থেকে এই সেবাটি নিতে পারেন। ফাইন্ড মাই ডিভাইস অ্যাপটি নামাতে চলে যান গুগল প্লে স্টোরে। সেখানই পাবেন অ্যাপটি। ব্রাউজার থেকে ঢুকতে এই লিংকে প্রবেশ করুন : যঃঃঢ়ং://িি.িমড়ড়মষব.পড়স/ধহফৎড়রফঃরপ
মোবাইল অ্যাপের সাহায্যে হারানো মোবাইল খুঁজে বের করা
যদি আপনার কোনো মোবাইল হারিয়ে যায় এবং সেই সেটটিতে গুগল অ্যাকাউন্ট সাইন ইন করা থাকে, তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে অন্য মোবাইল থেকে হারানো মোবাইলটিকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। অন্য একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে প্রথমে আপনার হারানো মোবাইলে থাকা গুগল অ্যাকাউন্ট দিয়ে সাইন ইন করুন। সাইন ইন করার পরে প্লে স্টোর থেকে ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ অ্যাপটি ইনস্টল করুন। মোবাইলে অ্যাপটি ‘ফাইন্ড ডিভাইস’ হিসেবে থাকবে। অ্যাপটি চালু করলে প্রথমেই কোনো গুগল অ্যাকাউন্টের সাহায্যে অ্যাপটি ব্যবহার করতে চান তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। অতঃপর আবার পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাপ থেকে অ্যাকাউন্টে সাইন ইন করতে হবে। সাইন ইন করার পর মানচিত্রের মতো একটি পেজ দেখবেন। এই পেজটিতে মূলত গুগল ম্যাপের সাহায্যে আপনার মোবাইলের লোকেশন দেখানো হবে। যেসব মোবাইলে এই গুগল অ্যাকাউন্টটি সাইন ইন করা আছে সেসব মোবাইলই এখানে দেখাবে। চিত্রের লাল কালি দ্বারা চিহ্নিত অংশে কোনো মোবাইলের তথ্য দেখতে চান তা নির্ধারণ করতে পারবেন। তবে মোবাইলের লোকেশন দেখা ছাড়াও এ অ্যাপের সাহায্যে তিনটি করণীয় বিষয় রয়েছে। ১. প্লে সাউন্ড, ২. সিকিউর ডিভাইস, ৩. ইরেজ ডিভাইস।
প্লে সাউন্ড : নাম থেকেই বুঝতে পারছেন, এর মাধ্যমে মূলত মোবাইল থেকে আওয়াজ করা হয়। এর মাধ্যমে আপনার হারানো বা চুরি যাওয়া মোবাইলটিতে পাঁচ মিনিট অ্যালার্ট টোন বাজতে থাকবে। মোবাইলটি ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ বা ‘সাইলেন্ট মুড’-এ থাকলেও শব্দ হবে। আপনি যদি নির্দিষ্ট আবদ্ধ স্থানে মোবাইলটি হারিয়ে ফেলেন তাহলে সেখানে মোবাইল খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় এটি। অবশ্য চুরি হওয়া মোবাইলের ক্ষেত্রে যার কাছে ডিভাইসটি রয়েছে, সে দূরে থাকলে আপনি সেখানে পৌঁছানোর আগেই সে হয়তো মোবাইলটি বন্ধ করে দেবে।
সিকিউর ডিভাইস : অনেকেই মোবাইলে অনেক ছবি-ডকুমেন্ট ইত্যাদি জমা রাখেন। তা হারিয়ে গেলে যেমন সমস্যা, অন্যের হাতে পড়লে আরও বড় সমস্যা। এ সমস্যা থেকে বাঁচতে সেটাই ফিচার মোবাইলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারলে এই ফিচারের সাহায্যে খুব সহজেই মোবাইলকে পুরোপুরি লক করে ফেলা যায়। ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি কার্যকর হয়। ফলে মোবাইলটি কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। এর পাশাপাশি আপনার ডিভাইসে সর্বোচ্চ ১০০ বর্ণের একটি মেসেজও পাঠাতে পারবেন আপনি।
ইরেজ ডিভাইস : হারিয়ে যাওয়া মোবাইলে নিজের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে শেষ সম্বল ইরেজ ডিভাইস। যদি মোবাইল উদ্ধারের সব আশা ত্যাগ করেন তাহলে এই ফিচারটি ব্যবহার করতে পারেন। এর মাধ্যমে মোবাইলটিতে থাকা সব ডাটা ধ্বংস হয়ে যাবে। একই সঙ্গে মোবাইলে সাইন ইন করা আপনার গুগল অ্যাকাউন্টটিও মুছে যাবে। ফলে আর কখনোই ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’-এর সাহায্যে এটিকে খুঁজে বের করতে পারবেন না। তবে এর মাধ্যমে আপনার মোবাইলের স্পর্শকাতর তথ্যগুলো অন্যের হাতে পড়া থেকে বিরত থাকবে। মূলত এই তিনটি পরিষেবার মাধ্যমেই ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ কাজ করে।
আইএমইআইয়ের মাধ্যমে হারানো মোবাইল উদ্ধার
আইএমইআই হলো যেকোনো মোবাইল ফোনের পরিচয়দানকারী সংখ্যা। এর পূর্ণরূপ হলো- ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি। এটি এমন একটা সংখ্যা, যা প্রতিটি মোবাইলের জন্য আলাদা থাকে। এই সংখ্যার মাধ্যমে একটি মোবাইলকে অন্য যেকোনো মোবাইল থেকে নিশ্চিতভাবে আলাদা করা যায়। শুধু তা-ই নয়, যদি আপনার হারানো বা চুরি যাওয়া মোবাইলটি থেকে সব তথ্য মুছে ফেলা হয় এমনকি সিমও পরিবর্তন করা হয়, তাহলেও এই নম্বরটির সাহায্যে মোবাইল খুঁজে বের করা সম্ভব। কারণ ওই মোবাইলটিতে যে সিমই ঢোকানো হোক না কেন, সেই সিম যখন তার কাছের মোবাইল টাওয়ারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে তখনই সেই সংযোগের মাধ্যমে মোবাইলের ওগঊও তথ্য সিম কোম্পানির কাছে চলে যাবে এবং ওগঊও নম্বরটিকে যদি আগে থেকে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়, তাহলে মোবাইলটির অবস্থান খুঁজে বের করা যাবে। আইএমইআই নম্বরকে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখতে চাইলে মোবাইলটিকে ব্লকও করে দেওয়া যেতে পারে। ফলে ওই মোবাইলের সাহায্যে আর কোনো মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাবে না। অর্থাৎ কথা বলা যাবে না অথবা ডাটা ব্যবহার করা যাবে না। কার্যত মোবাইলটি অকার্যকর হয়ে পড়বে। বর্তমানে দেশে অবৈধ মোবাইলের ব্যবহার দমনে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। তবে আইএমআইয়ের মাধ্যমে মোবাইল উদ্ধার করার পদ্ধতিটির একটি সমস্যা রয়েছে। এটি আসলে সর্বসাধারণের জন্য ওপেন কোনো সোর্স নয়। এভাবে মোবাইল উদ্ধার করতে হলে সরাসরি সিম কোম্পানি ও পুলিশের সহায়তা লাগবে। সাধারণত মোবাইল হারানো বা চুরি হওয়ার ঘটনায় কখনোই এত বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কোনো মামলায় হারানো মোবাইল অত্যন্ত জরুরি আলামত হলে আদালতের নির্দেশে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তাই ব্যক্তিগতভাবে আইএমইআইয়ের সাহায্যে মোবাইল খুঁজে পাওয়ার আশা না করাই ভালো।
আইএমইআইয়ের ভুয়া যত অ্যাপ
প্লে স্টোরে সার্চ দিলেই নানা রকম আইএমইআই ট্র্যাকার অ্যাপ পাওয়া যায়। এগুলো মূলত হ্যাকারদের বানানো ভুয়া অ্যাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। অ্যাপগুলোর রিভিউ সেকশনে ঢুকলেই হ্যাকারের ভুয়া গুণগান অথবা আসল রিভিউয়ারের তিক্ত অভিজ্ঞতা চোখে পড়বে। আইএমইআই দিয়ে মোবাইল খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। তাই এ ধরনের মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড না করাই ভালো। এতে কোনো লাভ তো হবেই না, উলটো আপনার বর্তমান মোবাইলও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। একইভাবে আরও অনেক অ্যাপ রয়েছে, যেগুলো আইএমইআই ব্যবহারের দাবি না করলেও মূলত ‘গুগল ফাইন্ড মাই ডিভাইস’-এর অনুরূপেই বানানো। এ ধরনের অ্যাপ গুগলের মতো একই পদ্ধতি অনুসরণ করেই কাজ করে। কিন্তু থার্ড পার্টি এসব অ্যাপ ব্যবহারের চেয়ে গুগলের অ্যাপের ওপর নির্ভর করা অনেক যৌক্তিক ও নিরাপদ মনে করে। তবে আপনি যে কোম্পানির মোবাইল ব্যবহার করেন সেই কোম্পানি যদি এ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে, তবে তা গ্রহণ করা যৌক্তিক। যেমন- স্যামসাং ব্যবহারকারীরা গুগল অ্যাপসের মতোই একটি অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে।
/এসকে