প্রকাশ: সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৯:০০ এএম (ভিজিট : ১৬২)
মাঠ প্রশাসনে ইউএনওদের অসৌজন্যমূলক আচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে উপজেলার চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবার সামনে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের ট্রফি ভেঙে ফেলেছেন বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহরুবা ইসলাম। এ ঘটনার পর ইউএনওকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর এক দিন আগে গত বৃহস্পতিবার বগুড়া সদরের ইউএনও সমর পালের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে লাঠি দিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া ইউএনওদের আচরণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করা এবং মস্তানদের মতো আচরণের অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো ইউএনওর বিরুদ্ধে। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সেটা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হবে।’
গত ২১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু। তিনি ওই সাংবাদিককে ‘বেজন্মাও’ বলেন। এ ঘটনার একটি অডিও প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ হয়। ঘটনার তিন দিন পর ওই ইউএনওকে ওএসডি করা হয়। সাংবাদিকের সঙ্গে ইউএনওর ভাষা ব্যবহারকে ‘মস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি নোটিস জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ইউএনওকে হাইকোর্টে তলব করা হয়। গত বছরের ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করারও অভিযোগ ওঠে।
নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়। এ আচরণবিধি এবং চাকরিবিধি-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিয়েই কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়ে থাকেন। উপজেলাধীন প্রায় শতভাগ কমিটির কার্যাবলি নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সভাপতি, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করা হয়েছে। অথচ উপজেলা আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী উপদেষ্টা হবেন একমাত্র স্থানীয় সংসদ সদস্য। এ নিয়ে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি উপজেলা চেয়ারম্যানরা সংবাদ সম্মেলন করে ইউএনওদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং বিভাগীয়ভাবে অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানা যায়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত ১০ বছরে প্রশাসনের প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জমা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচশর মতো বিভাগীয় মামলা দায়ের হলেও এগুলোতে একশর মতো কর্মকর্তাকে গুরুদণ্ড ও লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির একেবারেই কম। সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক। কিন্তু দেশের শাসনব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে তাতে ইউএনও, ডিসিসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের প্রভু এবং জনগণকে প্রজা মনে করেন। উপজেলাগুলোতে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে স্থানীয় সরকারের মূল বিষয় চাপা পড়ে যাচ্ছে। তাদের কাজে বাধা তৈরি করছে ইউএনওদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব।
উপজেলা আলীকদম, বগুড়া সদর, বোয়ালমারী, টেকনাফ, নওগাঁর বদলগাছির ইউএনওদের আচরণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে মোটেও শোভন নয়। বেশ কয়েকজন ইউএনওর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠায় উপজেলা পর্যায়ে শাসনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার বিষয়টি সামনে এসেছে। স্থানীয় সরকার ধারণাটি হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের একটা সরাসরি যোগাযোগÑযাতে স্থানীয় আকাক্সক্ষা ও কল্যাণ অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু ইউএনওরা নিজেদের সরকারি কর্মচারী না ভেবে উপজেলার শাসকের ভূমিকা পালনে ব্রত হয়েছেন।
ইউএনওদের অসৌজন্যমূলক আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেসব কর্মকর্তা বেপরোয়া আচরণ করেছেন, বিভাগীয় তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। তাহলেই কেবল মাঠপর্যায়ের প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা জরুরি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মতৎপরতায় সরকারের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হোক। মানুষ সেটার সুফল ভোগ করুক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।