করোনা মহামারি কাটিয়ে গতি ফিরেছে দেশের পর্যটন শিল্পে। দেশি-বিদেশি পর্যটনে মুখর হয়ে উঠেছে পর্যটন এলাকাগুলো। ফলে আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পর্যটননির্ভর অর্থনীতি। গত এক বছরে এ খাত থেকে চার হাজার ৩২ কোটি আয় হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন।
পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে ইতোমধ্যে ‘ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান’ হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০টি গাইডলাইন প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী কাজ করছে। এ ছাড়া করোনার কারণে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বিদেশিদের ভিসা দেওয়ার বিধিনিষেধও সোমবার তুলে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। আগারগাঁওয়ে পর্যটন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।
এদিকে বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে আজ সারা দেশে বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২২ যথাযোগ্য মর্যাদা ও আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন হচ্ছে। এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘রিথিঙ্কিং ট্যুরিজম’ অর্থাৎ পর্যটনে নতুন ভাবনা। দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে পর্যটন করপোরেশন। আজ র্যালির মাধ্যমে কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। এরপর থাকছে লাইভ কুকিং শো, দুই দিনব্যাপী খাদ্যোৎসব, এক দিনের স্বল্পমূল্যের সিটি প্যাকেজ ট্যুর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ আরও অনেক কিছু।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ৪৮টিসহ প্রায় তিন হাজার দর্শনীয় স্থাপনা রয়েছে। পর্যটনযোগ্য আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে এক হাজার ৭০০টি। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি দেশি পর্যটক এবং পাঁচ থেকে ছয় লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করে। ২০১৯ সালে তিন লাখ ২৩ হাজার ২৯৫ জন বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছে। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার প্রভাব থাকায় স্থবির হয়ে পড়ে এ খাত। তবে বর্তমানে করোনা প্রকোপ কমে যাওয়ায় আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে পর্যটন খাত।
পর্যটন বাংলাদেশের জিডিপিতে বছরে ৪ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি অবদান রাখে। ২০১৯ সালে ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অবদান রেখেছে এ খাত। একই সঙ্গে পর্যটন রফতানির মাধ্যমে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। তবে করোনার কারণে এ আয় নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোটায়। করোনাকালে ৩০ হাজার কোটি টাকা লোকসানের কথা জানান খাতসংশ্লষ্টরা।
পর্যটননির্ভর অর্থনীতি গতিশীল করতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন খাতে চার হাজার ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এ বছর আট হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ দ্বিগুণ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক মো. জিয়াউল হক হাওলাদার। এ ছাড়া দেশি এবং বিদেশি পর্যটক থেকে এ খাতে আয় হয়েছে চার হাজার ৩২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে যথাযথ ব্র্যান্ডিংই পারে বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে বিশে^র সামনে নতুন করে তুলে ধরতে। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে পর্যটনের ব্র্যান্ডিং বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। ঢেলে সাজানো হচ্ছে ওয়েবসাইটগুলো। সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে প্রচারণা।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের সময়ের আলোকে বলেন, ‘পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও জেলা প্রশাসন মিলে সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। আমরা দেশের ৬৪টি জেলায় মিটিং করেছি। ইতোমধ্যে প্রতিটি জেলায় ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য জেলা প্রশাসন কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রথম টার্গেট চায়না ও ভারতীয় পর্যটক, এরপর কোরিয়া ও জাপান। ফেসবুক মার্কেটিংয়ে তিনটি বিদেশি ভাষা যুক্ত করা হবে, যাতে বিদেশি পর্যটকরা সহজে আমাদের দেশ সম্পর্কে জানতে পারে।’
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বজুড়ে পর্যটকসংখ্যা পঞ্চাশের দশকে ছিল দুই কোটি ৫০ লাখ। তা এখন বেড়ে ২০০ কোটিতে পৌঁছেছে। ২০১৯ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কমপিটিটিভনেস রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম দেখানো হয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিল ১২৫তম। ২০১৮ সালের ওআইসির আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঢাকাকে ওআইসি পর্যটন শহর-২০১৯ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে মুসলিম দেশগুলোর অনেক পর্যটকের কাছে বাংলাদেশ নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করেছে।
সোমবার আগারগাঁওয়ে পর্যটন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ ছিল। অবশেষে আজ থেকে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আসার বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলো। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভা শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সংকট থেকে উত্তরণের উপায় ও ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক পর্যটন বাজারে সুবিধা অর্জনের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ইতোমধ্যে একটি ‘ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান’ নিয়েছে। এ পরিকল্পনাভুক্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০টি গাইডলাইন প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী কাজ করছে। এর ফলে ইতোমধ্যে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গতি ফিরছে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পে। টেকসই পর্যটন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।’
/আরএ