ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারের সব অর্জন ধুলোয় মিশে যেতে বসেছে। কোনোভাবেই বিতর্কিত কাণ্ড থেকে সংগঠনটিকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। কমিটি বাণিজ্য, পদ-পদবি, হল দখল, সিট বাণিজ্য, খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, ধর্ষণ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে নেতৃত্বের অদক্ষতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ঐতিহ্য হারাচ্ছে সংগঠনটি। আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকারে থাকায় ক্ষমতার প্রভাবে উচ্ছৃঙ্খলতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রশ্ন উঠেছে, অপ্রতিরোধ্য ছাত্রলীগের লাগাম টানবে কে?
সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ যখন দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে, ঠিক সেই সময়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছাত্রলীগ। ইতোমধ্যে কয়েকটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সংগঠনটি এখন আলোচনার শীর্ষে। বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে সংগঠনটিতে। ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষুব্ধ কমিটির অনেক নেতা। এ ছাড়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি দুই মাস অন্তর নির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র একটি সাধারণ সভা হয়েছে। কাউন্সিলর, কেন্দ্রীয় কমিটি, সম্পাদকমণ্ডলীর সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ৩০১ সদস্য নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এর বাইরে গিয়ে সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। অন্য কোনো নেতার সঙ্গে আলোচনা না করেই ‘জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক’ লিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এতে ঠিকমতো মূল্যায়ন না পাওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ।
সম্প্রতি শীর্ষ এ দুই নেতার বেশকিছু কর্মকাণ্ডের কারণেই এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নেতাদের মূল্যায়ন না করা, কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও সম্মেলনের প্রস্তুতি না নেওয়া, বিভিন্ন ইউনিটে নিজেদের এলাকার প্রার্থীদের রাখা, কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢালাওভাবে পদ দেওয়া, ভাগ-বাঁটোয়ারায় গরমিল, যোগ্যতার মাপকাঠি বিবেচনা না করে কমিটি দেওয়া, সংগঠনে অনুপ্রবেশ ঘটানো এবং বিলাসবহুল জীবনযাপনসহ নানা অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা সংগঠনটির এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডে দল ও সরকারের সব অর্জন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। সরকার দেশের মানুষের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করলেও ছাত্রলীগের কারণে বদনাম হচ্ছে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। সংগঠনটির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সেটি সম্ভব না হলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে।
এদিকে গত ২৬ আগস্ট ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। এতে রিভার বিরুদ্ধে দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের জোর করে নিয়ে যাওয়াসহ সিট বাণিজ্য, ক্যান্টিন থেকে চাঁদা দাবি ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার রাতে ইডেন মহিলা কলেজে সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর থেকেই ক্যাম্পাসজুড়ে অস্থিরতা চলছে। আধিপত্য, হল দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে নতুন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া হলের ছাত্রীদের কটূক্তি ও অশালীন বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। শুধু অশালীন বক্তব্যই নয়, নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি ও সংঘর্ষে লিপ্ত হন ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। শুধু ইডেন কলেজ নয়, দেশজুড়ে প্রায় সব জায়গায় এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড তদন্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তিলোত্তমা শিকদার এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশিকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ।
এ ছাড়া রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানা ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গঠিত রাজশাহী কলেজ মুসলিম হল ছাত্রদলের কমিটিতে ৬ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এর আগে তিনি ছাত্রশিবির করতেন। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রানা রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগ সভাপতি জয়ের মায়ের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ছাত্রশিবির করা রানা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির পদ পেয়েছেন। এ ছাড়া জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমির মাদক গ্রহণের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক শেখ শামীম তূর্য, উপ-আইন সম্পাদক আপন দাস এবং সহ-সম্পাদক তানভীর আব্দুল্লাহ। তারা তদন্ত করতে গিয়েই অভিযুক্তদের টাকায় খেয়েছেন ও থেকেছেন। গত ৩১ জুলাই রাতে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়। এতে সভাপতি হন ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত, সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়। আরাফাতের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির নিচতলায় অবস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় ওই বছরের ৩০ মার্চ তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন তাকে বহিষ্কার করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক-বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল সময়ের আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে আমরাও বিব্রত। সম্প্রতি কমিটি বাণিজ্য, পদ-পদবি, হল দখল, সিট বাণিজ্য, খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এমন অভিযোগ আসলে আমাদের কষ্ট লাগে।’ তিনি বলেন, ‘আশা করছি আসছে অক্টোবরেই ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এই কমিটিরই সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, যেটি ছাত্রলীগের ইতিহাসে প্রথম। আগামী দিনে ইমেজ সম্পন্ন কেউ আসবে।’
এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু সময়ের আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগে যারা কমিটি বাণিজ্য, পদ-পদবি, হল দখল, সিট বাণিজ্য, খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করে তারা ছাত্রলীগের কেউ হতে পারে না। কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ ছাত্রলীগ করার যোগ্যতা রাখে না। আজ যারা ছাত্রলীগকে ঘোলাটে পরিবেশের দিকে নিয়ে গেছেন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন, তারা অনুপ্রবেশকারী। আর যারা কমিটিতে থেকে অভিযোগ করেন যে, কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা হীনম্মন্যতায় ভোগেন।’
ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ড বিষয়ে সংগঠনের সাবেক সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ সময়ের আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটি বড় সংগঠন। এখানে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকতে পারে। তবে ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কোনো বিশৃঙ্খলা করলে, তাদের রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তাদের সংগঠন থেকে বের করে দেওয়া উচিত। আর কারও বিরুদ্ধে যদি নৈতিক স্খলনের অভিযোগ ওঠে এবং সেটি প্রমাণিত হয়, তাদের সংগঠনে রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সম্প্রতি সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। তবে এটি দেখবেন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
সংগঠনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার কোনো সত্যতা নেই। যেসব জায়গায় অভিযোগ উঠেছে, সেখানে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। রাজশাহীর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেখানে অডিও ক্লিপ ছাড়া আর কিছুর সত্যতা মেলেনি। জামায়াত-শিবিরকে পদ দেওয়ার অভিযোগও সত্য নয়। ছাত্রলীগের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতেই এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি ইডেন কলেজের ঘটনায় তদন্ত কমিটির বাইরেও আমি এবং সভাপতি তদন্ত করেছি। রিভার বিরুদ্ধে অডিও ক্লিপ ছাড়া আর কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। আমরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
অভিযোগ বিষয়ে কথা বলতে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
/এমএইচ/