বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত। অক্টোবরের প্রথম দিকে দাম বাড়ানোর এ ঘোষণা দেওয়া হবে। তবে সরকার না চাইলে দাম নাও বাড়তে পারে। খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ছে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা বিপিডিবি। নিজস্ব উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি ও বেসরকারি মালিকানাধীন কেন্দ্রের কাছ থেকে কিনে পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির কাছে পাইকারি দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আসছে।
বিপিডিবি বর্তমান দর ইউনিটপ্রতি পাঁচ দশমিক ১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে আট দশমিক ৫৮ টাকা করার আবেদন করে। বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি ভর্তুকি ছাড়া আট দশমিক ১৬ টাকা করার মতামত দেয়, যা নজিরবিহীন।
বিপিডিবির পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল দুই দশমিক ১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক ১৬ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে চার দশমিক ২৪ টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য খরচ। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবির। বিইআরসি আইন অনুযায়ী, গণশুনানির পর ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে আদেশ দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল সময়ের আলোকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে একটি আদেশ জারি করতে হবে। হ্রাস-বৃদ্ধি যাই হোক, একটা হবে। খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে না।’
কমিশন সূত্র জানায়, গ্যাসের আগের দর ইউনিটপ্রতি চার দশমিক ৪৫ টাকা বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে বিপিডিবি। প্রস্তাবের পর ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম বেড়েছে ৫৭ পয়সা করে। ফার্নেস ওয়েল দিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো সেটা এখন কয়লা দিয়ে হচ্ছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি হচ্ছে না। পাশাপাশি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রামপাল, পায়রা এবং ভারতের আদানী থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এগুলোর দাম পাঁচ-ছয় টাকার বেশি পড়বে না। এখানে অনেক সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া আগের চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় বিপিডিবির খরচ কমেছে। এগুলো হিসাবে ধরলে পাইকারিতে দাম না বাড়িয়ে কমানো উচিত।
সূত্র জানায়, অতীতে কখনো এত বেশি পরিমাণে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়ার নজির নেই। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়ায় কারিগরি কমিটি এ প্রস্তাব করে। তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সরকার একটা বড় ধাক্কা খায়, সে জন্য এখনই পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়নো নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। এ জন্যই কমিশন সময় নিচ্ছে। সরকার যে বিষয়ে গ্রিন সিগন্যাল দেবে, সে অনুযায়ী ঘোষণা আসবে।
কমিশনের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, বিপিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে, কমিশন সে প্রস্তাবে একমত হয়নি। আমরা খরচভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করি। কমিশন তাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত এবং নিজেরা খোঁজখবর নিয়ে যদি দেখে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে, সেটার সঙ্গে সরকারের ভর্তুকি যোগ করে যতটুকু না বাড়ালে নয় সেটুকু বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া। আর যদি দেখা যায়, বাড়ানোর প্রয়োজন নেই, তাহলে তো বাড়ানোর কোনো প্রশ্নই আসে না।
তারা বলেন, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ১৫-২০ শতাংশ বাড়ানো যেতে পারে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কমিশন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আর ভোক্তা পর্যায়ে এখনই বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ কোম্পানিগুলো এখনো খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব করেনি। পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ার পর যদি খুচরায় না বাড়ে তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। কিছুদিন আগে গ্যাসের দাম বেড়েছে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। সেই ধাক্কা এখনো সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে জনগণ। পাইকারি দাম বাড়ানো হলে, আজ হোক-কাল হোক খুচরা পর্যায়েও বাড়বে।
ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম সময়ের আলোকে বলেন, ‘বিপিডিবির যে প্রস্তাবের মূল্যায়ন করে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ, বিপিডিবির উৎপাদন কমানো হয়েছে। ফলে বিপিডিবির উৎপাদন খরচ কমেছে, তাই দাম না বাড়িয়ে কমানো উচিত।’
প্রসঙ্গত, গত এক যুগে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এ সময়ে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ দাম বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় সরকারি ভর্তুকি তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরে পাইকারি পর্যায়ে আট দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় পাঁচ দশমিক ৩ শতাংশ।