ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা রোববার ১ অক্টোবর ২০২৩ ১৫ আশ্বিন ১৪৩০
ই-পেপার রোববার ১ অক্টোবর ২০২৩
https://www.shomoyeralo.com/ad/Amin Mohammad City (Online AD).jpg

https://www.shomoyeralo.com/ad/780-90.jpg
মেসিডোনিয়ায় জিপসিদের বস্তি সুটো ওরিজারি
মঈনুস সুলতান
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২২, ৬:০৫ এএম | অনলাইন সংস্করণ  Count : 113

মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়া নগরীর দৃশ্যপটের বিরাট এক অংশ জুড়ে আছে বেলেপাথরে নির্মিত কালচে-ধূসর রঙের একটি চকমিলান কেল্লা। প্রায় দুই-আড়াইশ বছর হতে চলল, এ দুর্গটি আর ব্যবহার হচ্ছে না যুদ্ধবিগ্রহ বিষয়ক কোনো তৎপরতায়। বছর পনেরো আগেও মেসিডোনিয়া নামক আলেকজান্দারের স্মৃতিবিজড়িত দেশটি ছিল যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অন্তর্গত। তো তখন থেকে এ কেল্লার কিছু কিছু এলাকা খুলে দেওয়া হয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য।

আমি ধর্মীয় সহিষ্ণুতাবিষয়ক একটি সম্মেলনের হিল্লা ধরে দিন দশেক হলো স্কোপিয়া নগরীতে বসবাস করেছি। সে সূত্রে আয়োজিত একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের ভেন্যু হচ্ছে কেল্লার কুচকাওয়াজের মাঠ। তো আমি তাতে শামিল হতে এসে, মিনিট কয়েক আগে প্রবেশ করেছি দুর্গের সদর-দরজা দিয়ে।

কেল্লার ভেতর দিককার পরিসর বিশাল। ঠিক বুঝতে পারি না সান্ধ্য-পার্টির এন্তেজাম হয়েছে কোন দিকে।  আমাদের ডেলিগেশনের আরেক সদস্য প্রফেসর মাশা ওনিল বসনিয়া থেকে এসে পৌঁছেছেন। একাডেমিক গবেষণার কারণে বলকান অঞ্চলে প্রফেসর ওনিল খুবই পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তার যোগাযোগে স্কোপিয়ার আমেরিকান কলেজ আজকে কেল্লার চত্বরে সান্ধ্য-পার্টির আয়োজন করেছে। এ অনুষ্ঠান শুরু হবে রোদ মরে যাওয়ার পর ঠিক গোধূলি লাগার লগ্নে। আমেরিকান কলেজের আয়োজকরা ডেলিগেশনের সদস্যদের জানাশোনা অনেককে দাওয়াত করেছেন। আমার পরিচিতদের মাঝে লুলজিম আবাসি, কাজমি হায়দার সিফতে, এমিনি এলরিম প্রমুখসহ আরও কয়েকজন এ রিসেপশনে আসছেন। 

পার্টিতে যাতে খাবারের জোগান যথেষ্ট হয়, এ জন্য আমরা সবাই কিছু খাবার ও পানীয় কনট্রিবিউট করছি। আমার হাতের দুটি বড়সড় প্যাকেটে আছে বেশ কিছু তাজা দোলমা ও মধুতে জারিত মুচমুচে বাকলভা। এগুলো ক্যারি করতে ক্লান্ত লাগে, তাই মূর্তিগুলোর কাছাকাছি একটি পাথরে বসে একটু জিরাই। 

আমার পাশ দিয়ে ঢোল-ডফকি ও দোতার নিয়ে হেঁটে যায় বাদামি গাত্রবর্ণের জনা ছয়েক জিপসিদের ছোট্ট দল। আমি অবগত যে, আজকের সান্ধ্য-পার্টিতে গানবাজনার জোগান দেওয়ার জন্য আমেরিকান কলেজ তাদের ডেকে এনেছেন। যেতে যেতে কালো চুলের মানুষগুলো আমাকে খেয়াল করে দেখেন। কিন্তু আমি তাদের প্রতি হোস্টাইল বোধ করছি বলে আগ বাড়িয়ে হ্যালো বলতে যাই না। 

আজ সকালে আমি গিয়েছিলাম স্কোপিয়া শহরের বাইরে তুর্কি আমলের একটি ভগ্ন সরাইখানায়। আধভাঙা এ ইমারতের ভেতর দিককার হলঘরটি সাফসুতরা করে এক মেসিডোনিয়ান দম্পতি ওখানে রেস্তোরাঁ চালাচ্ছে। আমি পার্টিতে নিয়ে আসার জন্য টেকআউট হিসেবে দোলমা ও বাকলভার অর্ডার করি। খাবার তৈরি হতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগবে জানালে, আমি পোড়ো সরাইয়ের ভেতর দিককার বারান্দায় কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি টং-দোকানে আসি। 
দোকানটি চালাচ্ছেন এক জিপসি পুরুষ। মানুষটি দিব্যি ইংরেজি বলতে পারেন। আমি তার কাছ থেকে এসমা রেডজেপোভার একটি সিডি খরিদ করি। মেসিডোনিয়ার নামজাদা গায়িকা এসমা কুইন অব জিপসি হিসেবে পরিচিত। শোনা যায়, যুগোস্লাভিয়ার বিগত যুগের প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটো নাকি জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে এসমা রেডজেপোভাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে। এসমা দিল্লিতে এসে তার লোকনন্দিত ‘বাবি বাবি আ ব্রে বাবি’, বা ‘নৃত্যপ্রিয় রূপসী বালিকার গল্প’, গেয়ে নাকি মাইফেল গুলজার করে দিয়েছিলেন।  

তো স্কোপিয়ার এ পড়ো সরাইখানার টং-দোকান থেকে খুব অল্প পয়সায় পাইরেট করা এসমার সিডি কিনতে পেরে বেশ ভালোই লাগে। টং-দোকানির সঙ্গে কথাবার্তায় জানতে পারি, খুব কাছেই মেসিডোনিয়ার রোমা সম্প্রদায় বা জিপসিদের আবাসিক এলাকা সুটো ওরিজারির অবস্থান। চাইলে বাস পাকড়ে মিনিট সাতেকে ওখানে চলে যাওয়া যায়। তিনি আরেকটি ইন্টারেস্টিং তথ্য দেন, আজ রোদ একটু চড়লে রোমা তরুণীরা নাকি ‘শক্তি’ বলে সহস্র যুগ আগের এক দিব্য প্রতিমার স্মরণে নৃত্য করবে। আমার ফিঙ্গার ফুড তৈরিতে আরও ঘণ্টা দেড়েক লেগে যাবে। সুতরাং ভাঙা সরাইয়ের চাতালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করে আমি চলে আসি বাসস্টপে। 

বাস আসতে একটু দেরি হচ্ছে, তাই দাঁড়িয়ে থেকে রোমা গোত্রের মানুষজন বা জিপসিদের কথা ভাবি। সতত ভ্রাম্যমাণ এ জনগোষ্ঠীর আদি-পুরুষ এবং নারীরা প্রায় ছয় হাজার বছর আগে ভারতবর্ষ থেকে তুরস্ক হয়ে বসফরাস পাড়ি দিয়ে ইউরোপে এসে পৌঁছান। তাদের মৌখিক জবানের সঙ্গে যে সংস্কৃত ভাষা এবং পরবর্তী যুগের হিন্দি, পাঞ্জাবি বা রাজস্থানি ভাষার লিঙ্ক আছে তা নিয়ে একাধিক ভাষাতাত্ত্বিক মুসাবিদা করেছেন প্রামাণ্য কিতাবাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের বর্ণবাদী জুলুমে নিহত হয় রোমা বা জিপসি সম্প্রদায়ের ৬০ হাজার মানুষ। ইউরোপের নানা দেশে থিতু না হওয়া জিপসিরা আর্থিকভাবে খুব খারাপ হালতে বসবাস করলেও যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক শাসনে তাদের হাল-হকিকতের উন্নয়ন হয়। মেসিডোনিয়ার স্কোপিয়া নগরীর প্রান্তিকে সুটো ওরিজারিতে তারা স্থিতিশীল হালতে বাস করছেন-যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটোর আমল থেকে। তাদের আবাসিক এলাকা রোমা-মহালা বলে পরিচিত। 

বাস এক টানে আমাকে নামিয়ে দেয় জিপসিদের মহালায়। তাদের ঘরদুয়ারের গরিবি হালচাল, সড়কে খানাখন্দ দেখে আমি অবাক হই না তেমন। শুনেছি, মেসিডোনিয়ার রোমারা অনেকে ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমান হলেও পালাপার্বণে ত্রিশূলকে পবিত্র প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তাদের বিয়েশাদি ও সন্তানের জন্মানুষ্ঠানে আজ অবধি ব্যবহৃত হয় ভারতীয় কিছু রীতি-রিচুয়েল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবি-ইন্টারপ্রেটার ছাড়াই চলে এলাম সুটো ওরিজারিতে, এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আজ কিছু জানা যাবে কি? 

দুজন বয়স্ক মহিলা ঝুড়িতে করে সবজি, টমেটো ও ধনেপাতা বয়ে নিয়ে যেতে যেতে অবাক হয়ে আমাকে দেখেন! আমি হাত তুলে তাদের সম্ভাষণ জানাতে গেলে, বোধ করি শরম পেয়ে নারী দুজন হেডস্কার্ফ নামিয়ে মুখ আড়াল করেন। আমি ঢুকে পড়ি প্রায় নির্জন গলিতে। পথের পাশে স্তূপ হয়ে আছে আবর্জনা। লাঠি হাতে এক পুরুষ তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্যাঁক প্যাঁক করা তিনটি হাঁস। আমি তাকে সালাম-আলেক দিতে চাই, কিন্তু তিনি কোনো বিষয় নিয়ে এমন চোখ-মুখ খিঁচিয়ে হাঁটছেন, হয়তো পরমা পত্নীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না তার, স্পষ্টত বিদেশির সঙ্গে বাতচিত করার মুড নেই জিপসি এ পুরুষের। 

পরের গলিতে ঘরদুয়ারের হালত বেশ ভালো। এখানে আসতেই খানিক দূর থেকে ভেসে আসে ঢোল-ডফকি ও দোতারার সুরেলা আওয়াজ। গালিতে কয়েকটি কাচ্চাবাচ্চারও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তারা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে কী নিয়ে যেন মশগুল হয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে তাদের মাঝে ছড়ায় মৃদু উত্তেজনা। তাদের কেউ হাত নাড়ে, কোন বাচ্চা মুখ ভেংচায়, একটি মেয়েশিশু আমার দিকে উড়ন্ত চুমো ছুড়ে দিয়ে হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে ইশারা দেয়।

বাদ্যবাজনা প্রবল হচ্ছে, আন্দাজ করি যুবতীরা মত্ত হচ্ছে শক্তি আরাধনায়। কালীপূজার দেশের লোক আমি, কাপালিকদের বিষয়-আশয় সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল, এদের রিচুয়েলের কায়দাটা কী-জানতে বাসনা হয়। গলির শেষে মোড়, ফিরে আমি চলে আসি ছোট্ট চত্বরে। ওখানে গোল হয়ে বর্ণাঢ্য ঘাঘরা পরা যুবতীরা দামাইল নাচের কায়দায় হাততালি দিয়ে নৃত্য করছে। তাদের কুঁচি দেওয়া টপের পিঠ খোলা, তাই ওখানে রোদ পড়ে ঝলমল করছে উল্কি করে আঁকা চিত্ররাজি। পাশেই একটি চেনার গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তিন জিপসি পুরুষ বাজিয়ে যাচ্ছে বাদ্যযন্ত্রাদি। 

নাচের একপর্যায়ে নারীরা দেহভঙ্গিতে জ্যামিতির নকশা এঁকে বাঁকা হয়ে মাটি থেকে তুলে নেয় কাচের বোতল, একটি যুবতী তার কটিদেশে ঝোলানো বটুয়া থেকে বের করে স্ফটিকের করোটি। শিশিতে ছলবল করছে রঙিন তরল, তাতে শরাব না শর্ষের তেল ভরা-ঠিক বুঝতে পারি না, তবে জানতে বেজায় আগ্রহ হয় অধরা এ রমণীদের উদ্দেশ্য কী?

মেয়েদের বৃত্ত থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে এক নারী মাঝে মাঝে নৃত্যরতদের চিয়ার লিডারের ভঙ্গিতে উৎসাহিত করতে করতে মারাকাস হাতে ঝনঝনিয়ে আওয়াজ দিচ্ছে-‘চাজে শুকারিজে’। আমাকে কৌতূহলী দেখে মেয়েটি চোখ থেকে রোদচশমা খুলে তা চুলে গেঁথে কাছে যেতে ডাকে। 

আমি তাকে মেসিডোনিয়ান ভাষায় ‘জাদরাভো’ বা ‘হ্যালো’ বললে সে ‘নেমা নাসতো’ বা ‘ইউ আর ওয়েলকাম’ জবাব দিয়ে ইংরেজিতে পরিষ্কারভাবে জানতে চায়, ‘ডু ইউ হ্যাভ অ্যা কোয়েশ্চন?’ আমি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘চাজে শুকারিজের অর্থ কী?’ সে ফিক করে হেসে জবাব দেয়, ‘বিউটিফুল গার্লস
।’ তারপর কী যেন ভেবে আবার বলে, ‘ইউ নো দেয়ার আর মেনি বিউটিফুল গার্লস্ ইন জিসপি মহালা।’
 
আমি তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলে সে গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আর ইউ হিয়ার টু ফাক অ্যা জিপসি গার্ল?’ আমি বিব্রত হয়ে জবাব দিই, ‘নট অ্যাট অল, এ ধরনের কোনো বাসনা বা অভিলাষ আমার নেই, সিনোরিটা।’ আমার জবাবে সে তেড়িয়া হয়ে ক্যামেরার দিকে ইশারা করে বলে, ‘অ্যাবসোলিউটলি নো পিকচার, জাস্ট গেট দ্য ফাক আউট অব হিয়ার।’ 

আমি ঝুঁকে বাও করে ফরাসি ভাষায় ‘আঁবোয়া’ বা ‘গুডবাই’ বলে পিছু হটি। বাসস্টপের দিকে খিন্ন মনে হেঁটে যেতে যেতে ভাবি-জিপসিদের আদব-কায়দা না জেনে, অনুমতি না নিয়ে তাদের গ্রামে ঢুকে পড়া বোধ করি ঠিক হয়নি।

দুর্গের ভগ্ন দেয়ালের পাথরে বসে অনেকক্ষণ জিরানো হলো। আমি এবার উঠে দাঁড়াই। চেষ্টা করি জিপসি গ্রামের অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে আসতে। পড়তে পড়তে কোন গোয়েন্দা উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে এসে যাওয়ার মতো স্কোপিয়া শহর থেকে গুটিয়ে যাচ্ছে বিকালের আলো। রোদ মরে যাওয়াতে শহরের অজস্র ইমারত, চার্চের ঘণ্টা ঝোলানো টাওয়ার ও ভারদা নদীর প্রবহমান জল হয়ে উঠছে খানিক রহস্যময়। ভাবি-আর দেরি না করে এবার খুঁজে বের করতে হয় দুর্গ চত্বরের কোথায় জমেছে সান্ধ্য-পার্টি।

https://www.shomoyeralo.com/ad/Local-Portal_728-X-90 (1).gif



https://www.shomoyeralo.com/ad/Google-News.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com