ই-পেপার বুধবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৩
বুধবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৩

মূল্যস্ফীতির ধাক্কা ‘স্বর্গের দেশগুলোতেও’
আনিসুর রহমান
প্রকাশ: বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম  (ভিজিট : ১৬২)
‘মূল্যস্ফীতি’ শব্দটি আমরা আমজনতা বুঝি বা না বুঝি ১০ টাকার জিনিসের দাম ১২ টাকা বা ১৫ টাকা বা ২০ টাকা হাঁকলে পকেটে এবং আত্মারামে যে একসঙ্গে টান পড়ে এটুকু আমরা বুঝি। এ রকম অবস্থায় পড়া মানুষের বিশাল সংখ্যা ধনী-গরিব সব দেশেই আছে। তবে যারা সুযোগ-সুবিধার পালে হাওয়া লাগিয়ে জাতে উঠেছেন আভিজাত্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন, কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, বড় পদের সামরিক-বেসামরিক আমলা হয়েছেন তাদের কথা আলাদা। এরা পৃথিবীর সব দেশেই জমিনে-আকাশে সুনজরে থাকবেন। কিন্তু যারা জীবনের পুরোটা সময় যমদূতের খপ্পরে থাকেন সেসব সীমিত আয়ের নিম্ন আয়ের অথবা আয়হীন মানুষের অবস্থা মানচিত্রভেদে কী রকম সেটা একটু বলতে চাই।

তার আগে মূল্যস্ফীতির তালিকা বা পরিসংখ্যান থেকে কিছু তথ্য উল্লেখ করতে চাই। প্রথমে উল্লেখ করব পৃথিবীর সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতির কয়েকটি দেশের অবস্থান : মালদ্বীপ ০.২ শতাংশ; গ্যাবন ০. শতাংশ; জাপান ০.৬ শতাংশ; ফিজি ০.৮ শতাংশ; ভানুয়াটা ০.৯ শতাংশ, বলিভিয়া ০.৯ শতাংশ; সৌদি আরব ১.১ শতাংশ। এবার সবচেয়ে বেশি যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি সে রকম কয়েকটা দেশের অবস্থান তুলে ধরতে চাই : ভেনিজুয়েলা ১১৯৮ শতাংশ; সুদান ৩৪০ শতাংশ; লেবানন ২০১ শতাংশ; সিরিয়া ১৩৯ শতাংশ; সুরিনাম ৬৩ শতাংশ; জিম্বাবুয়ে ৬০ শতাংশ; আর্জেন্টিনা ৫১ শতাংশ; তুরস্ক ৩৬ শতাংশ।

এই সময়ে বিশ্বের গড় মূল্যস্ফীতি ৮.৮ শতাংশ; অন্যদিকে ইউরোপের গড় মূল্যস্ফীতি ১০.৭ শতাংশ; সুইডেনের মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ছিল ১০.৯ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১০.৮ শতাংশ। 

এশিয়ার গড় মূল্যস্ফীতি ১০.০ শতাংশ; এর বিপরীতে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বরে ছিল ৯.১০ শতাংশ, যা অক্টোবরে এসে দাঁড়িয়েছিল ৮.৯১ শতাংশ। 

সাদামাটাভাবে আমি যা বুঝি মূল্যস্ফীতি মানে জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে ফুলেফেঁপে উঠবে বা স্ফীত হবে বা বেড়ে যাবে। এই সত্য মেনে নিলে জিনিসপত্রের দাম গড়ে বাংলাদেশে শতকরা ৯ টাকা বা ১০ টাকা বাড়ার কথা। কিন্তু তা স্বাভাবিক স্ফীতির চেয়েও যখন ভৌতিক স্ফীতি বা ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের বেগে বেড়ে যায়, দুর্দশা-দুর্ভোগ হাহাকার বা দুর্ভিক্ষ তখনই হয় যখন মূল্য বাড়ার শতকরা হিসাবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় ।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে ১৯৪০-এর দশকে কলকাতার মাড়োয়ারিদের কথা বলেছেন, তারা কীভাবে সরকারকে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এবং দেশের মানুষকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ফন্দিফিকির করে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। আমরা কি সেই মাড়োয়ারির খপ্পর থেকে মুক্ত আছি? পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষের আশপাশে ওই দেশীয় মাড়োয়ারি নেই? ইউরোপ-আমেরিকায়ও কি মারোয়াড়ি আছে? সুইডেনেও কেউ মাড়োয়ারি আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে চাই না, তবে এসব এলাকায় জিনিসপত্রের দাম কী রকম তার একটা চিত্র তুলে ধরতে চাই। আর এই চিত্র থেকে মাড়োয়ারি-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরগুলো বের করে নিন।

এখানে উল্লেখ করতে চাই স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা পৃথিবীর উত্তর মেরু অঞ্চলের দেশগুলোকে বাইরের দুনিয়ার মানুষের অনেকেই পৃথিবীর স্বর্গ মনে করে থাকেন। আমি এর পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলতে চাই না। আমি কেবল বহুল চর্চিত বাংলা প্রবাদটা মনে করিয়ে দিতে চাই, দিল্লির লাড্ডু খাইলেও পস্তায়, না খাইলেও পস্তায়। পৃথিবীর ‘স্বর্গখ্যাত’ দেশগুলো হচ্ছে আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন। ‘স্বর্গের’ এই দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা কিঞ্চিৎ এদিক-সেদিক ছাড়া প্রায় কাছাকাছি। তাই সুইডেনের বাজারে গড়পড়তা জিনিসপত্রের দামের একটা চিত্র তুলে ধরতে চাই। এর থেকে পুরো এই ‘স্বর্গীয়’ এলাকার মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

এক লিটার দুধের স্বাভাবিক দাম সুইডিশ মুদ্রায় আট টাকা থেকে বেড়ে ১৫ টাকা; এক লিটার দই ১২ টাকা থেকে বেড়ে ১৮ টাকা; মুরগির কেজি ৩৮ টাকা থেকে ৫৮ টাকা; ভেড়ার মাংসের কেজি ১০০ টাকা থেকেই ১৮০ টাকা; গরুর মাংস ৭০ টাকা থেকে ১০০ টাকা; চালের দাম ১৭ টাকা থেকে ২৪ টাকা; ১০ কেজি আটার প্যাকেট ৬৪ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১২ টাকা; ১০ লিটার তেলের দাম ১৩৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬৫ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে; এক ইউনিট বিদয়াতের দাম যেখানে ছিল ৫০ পয়সা, সেটা বেড়ে এখন দুই টাকা ২৫ পয়সা। 

এই চিত্র যদি পৃথিবীর স্বর্গের দেশের মাড়োয়ারিরা করতে পারে, তাহলে পৃথিবীর নরকের দেশের চিত্র কেমন হতে পারে। আমরা যে যার মতো মিলিয়ে নিতে পারি।

আমাদের মতো দেশে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিতে কারা সবচেয়ে নাকাল অবস্থার মধ্যে পড়ে? সীমিত আয়ের মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষ আর আয়হীন মানুষ। পৃথিবীর স্বর্গের দেশগুলোতেও তাই। স্বর্গের দেশে সীমিত আয়ের মানুষ কারা? 

দিবাকেন্দ্রের কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, স্কুলের শিক্ষক, সংস্কৃতির নানা পেশার মানুষ গায়ক-শিল্পী, লেখক, দোকানের কর্মচারী, গ্রন্থাগারের কর্মী, পরিবহন শ্রমিক, হাসপাতালের কর্মী, কৃষক, নির্মাণশ্রমিক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী আর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতার মানুষেরা। এর আগে বাজারের চিত্র উল্লেখ করেছি। এখন এসব আয়ের মানুষ কীভাবে বাজারের এই ধাক্কা সামাল দেবেন? এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবেন? তার কিছু নমুনা এখানে উল্লেখ করছি। প্রথমত তারা বাজারে কাটছাঁট করবেন, তারপর শখ-আহ্লাদ ঝেড়ে ফেলবেন, ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করবেন, সিনেমা-নাটকে যাওয়া বন্ধ করবেন, প্রসাধনসামগ্রী কেনায় লাগাম ধরবেন, তুলনামূলক যেসব দোকানে জিনিসপত্রের দাম কম সেসব দোকান খুঁজবেন এবং ভিড় করবেন। বাইরে খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দেবেন কিংবা বন্ধ করে দেবেন। প্রয়োজনে অনাহারে থাকবেন দুই-এক বেলা বা দায়সারা গোছের কিছু একটা খেয়ে নেবেন। 

এমনকি কাপড়চোপড় কেনাও কমিয়ে দেবেন বা বন্ধ করবেন অথবা পুরোনো কাপড়ের দোকানে ভিড় করবেন। কাপড়ের দোকানগুলোতে বিক্রি কমে যাবে। এভাবে বাজারে চাহিদা কমে যাবে, বিনিময়ে আমদানিও কমে যাবে। আর এর চাপ গিয়ে পড়বে সেই সব দেশে, যেসব দেশে এই স্বর্গের দেশগুলো কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য জিনিস আমদানি করে থাকেন। 

‘স্বর্গের’ দেশের প্রান্তিক এবং সীমিত আয়ের মানুষের জন্য লঙ্গরখানাও খোলা হয়নি, এদের জন্য টিসিবির দোকানও খোলা হয়নি। কারও আয়রোজগারও হঠাৎ করে বেড়ে যায়নি। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বলতে যে বোঝায় এসব ‘স্বর্গের’ দেশের মানুষেরাও সেই ধাক্কার মধ্যে আছে। 
এবার আমাদের দুখিনী বাংলাদেশের কথা বলি। দুনিয়ার নরক বলি আর স্বর্গ বলি প্রায় সব দেশেই অতিমারি এবং যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে। সেই ধাক্কা থেকে আমাদের দেশ মুক্ত নয়। সত্য মেনে নিতে কোথাও কি কারও কোনো সমস্যা আছে? পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দেশগুলোতে সরকারের কোনো ভুলত্রুটি, ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে দায়ী করা হয়, বড়জোর সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীকে দুঃখ প্রকাশ করার জন্য বা পদত্যাগ করার জন্য দাবি তোলা হয়। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম। কথায় কথায় দিন-তারিখ ঠিক করে সরকারের বিদায়ের আজগুবি রব আর সংগীত চালু হয়ে যায়। এই যে যারা বলছেন সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলুন না ব্যর্থতাগুলো কী এবং কোথায়? এর বিকল্প করণীয় কী? 

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্নোক্ত কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ : খাদ্য, কৃষি, অর্থ, বাণিজ্য এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এখন আলাদা মন্ত্রণালয় ধরে ধরে ভুল পদক্ষেপগুলো চিহ্নিত করে এবং এর থেকে উত্তরণের বিকল্প পদক্ষেপ কী হতে পারে সেটা কি সরকারের যারা বিরোধিতা করছেন সংসদের ভেতরে ও বাইরে তারা কি দেখাতে পেরেছেন? বা দেখিয়েছেন? ‘স্বর্গের’ দেশগুলোতে বিরোধী দলও অনেক সময় বাজেট প্রস্তাব করে। এমনও হয়েছে বিরোধী দলের প্রস্তাবিত বাজেট পাস হয়েছে। সরকারকে সরকারে থেকে বিরোধী দলের বাজেট বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। 

মানুষের যেখানে বাঁচা-মরার প্রশ্ন তখন সেখানে বিকল্প কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব না দিয়ে হতাশ বিপদগ্রস্ত দিশেহারা মানুষদের বিভ্রান্ত করে কিসের দাবি-দফায় ও ধান্দায় জনদুর্ভোগকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি? প্রশ্নটা উভয় তরফকেই? সরকারবিরোধীরা কি শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছেন? আপনারা ছলেবলে কৌশলে কি ২০১৩ সালের হেফাজতিদের মতো অবস্থান নিতে চান? দেশ ও দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফায়দা লুটে নিতে চান? একেই বলে বুঝি ‘কাফনের কাপড় ভাগিয়ে নিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই করার হীন স্বপ্ন’। পৃথিবীর স্বর্গ ও নরকের প্রান্তের কোথাও এসব বরদাশত করা হয় না? আমাদের দুখিনী বাংলাদেশের সরকার বরদাশত কেন করবে? 

একটি শেষ কথা বলে এই লেখার ইতি টানছি। বিপদের এই কঠিন সময়ে বিরোধী দল বিএনপির নেতারা দেশের অন্দরের বিষয় নিয়ে বিদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন। এই দৃশ্য দেখে আমার কেবলই ১৭৫৭ সালে রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে যারা যোগসাজশ রক্ষা করতেন কল্পনায় তাদের চেহারা ছবি ভেসে ওঠে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও সীমারেখা যারা মানেন না, তাদের রাজনীতি বড়ই অশনিসংকেত। কালে-কালে দেশে-দেশে এমনটাই দেখা গেছে।

লেখক:
বাঙালি-সুইডিশ কবি ও নাট্যকার, সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close
https://www.shomoyeralo.com/ad/1698384544SA-Live-Update.jpg