আবুল হাসানের জন্য ভালোবাসা
টোকন ঠাকুর
|
![]() একজন পুরুষ তাকে রমণী বিবেচনায় নিলেই চলত! বাংলা কবিতার অকালপ্রয়াত কবি আবুল হাসানের আমি ভক্ত হয়ে উঠি সেই আমার উঠতি বয়সেই। মাত্র ২৮ বছরের জীবদ্দশায় কী মায়াময় কবিতা লিখে হাসান চলে গেছেন। তবু সেই ২৮ বছরেই কী সব দুর্দান্ত কবিতার জনক আবুল হাসান। হাসান বলেছেন, ‘প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না, আমি কে ছিলাম কী ছিলাম,? কেন আমি খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী, হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি হিরণ দাহ প্রায় ৩০ বছর আগে পড়া আবুল হাসানের কবিতা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। হাসানের আরও কত কবিতা আমার মুখস্থ হয়ে আছে! সম্ভবত আর কোনো কবির কবিতা আমার এভাবে মনে থেকে যায়নি। হাসানের কবিতার বিষণ্ন-মধুর আলুলায়িত জ্যোৎস্নায় পুড়তে পুড়তে আমিও প্রেমে পড়েছিলাম। শিশির ভিজিয়ে দিয়েছিল সমস্ত শরীর। বাংলা কবিতাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এতে তরুণ কবি আবুল হাসানের উসকানি ছিল ঢের। এই উসকানিই আবুল হাসানের কবিতার শক্তি। গত শতকের লেইট সিক্সটিজে উদ্ভাসিত আবুল হাসানের জীবদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ মাত্র তিনখানা। ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করো’ ও ‘পৃথক পালঙ্ক’। মাত্র ১০ বছরকাল তার কবিতা রচনার সময়। ঈর্ষাযোগ্য কবি তিনি। সময়ের আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসানের বোহেমিয়ান জীবন প্রায় মিথ হয়ে ওঠে। মিথ থেকে উঠে আসেন প্রজ্ঞাসুন্দরী সুরাইয়া খানম। কিন্তু বড় অকালেই হাসান আরও মিথ হয়ে যান তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে। বনানী গোরস্তানে আবুল হাসানের কবরে যে এপিটাফ লেখা আছে, সেই লেখা হাসানের কবিতাংশÑ‘যতদূর যাও ফের দেখা হবে/ কেন না, মানুষ যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক। ২৬ নভেম্বর, ১৯৭৫।’ আর আবুল হাসান জন্মেছিলেন ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট। হতে পারে ২০০০ সালে আমেরিকা থেকে ঢাকায় ফেরা নির্গুণ-ভক্ত আমাদের বন্ধু মৃগাঙ্ক সিংহ একটা কবিতার বই বের করল। সেই কাব্যগ্রন্থের নাম ‘নির্মলেন্দু গুণ’। বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখি আমি। শিল্পী মাসুক হেলাল প্রচ্ছদ করেন ‘নির্মলেন্দু গুণ’ কাব্যগ্রন্থের। তো এক রাতে আমরা কী করলাম! মৃগাঙ্ক বলল, ‘নির্মলেন্দু গুণ’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব করতে হবে। কোন অডিটোরিয়ামে করা যায়, অতিথি কারা থাকবেন, অডিয়েন্স কারা হতে পারে ইত্যাদি আলোচনার পর আমার প্রস্তাব মৃগাঙ্ক খুশি মনেই মেনে নেয়। সেই প্রস্তাব, ‘নির্মলেন্দু গুণ’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব হবে রাতে, বনানী কবরস্থানে, আবুল হাসানের কবরের মধ্যে বসে। চাঁদের আলো আর কবরস্থানের সোডিয়াম আলোয় আমরা নতুন কবিতার বই ‘নির্মলেন্দু গুণ’ থেকে কবিতা পড়ব, আমরাই শুনব। কবিতা পড়ার সঙ্গে আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত হব, যেন বা চাঁদের গায়ে লেগে থাকা শিশিরকণা সারারাত পান করে চলব। তাই করেছি। আবুল হাসানের কবরের মধ্যে সেই রাতে মৃগাঙ্ক সিংহ, মারজুক রাসেল, আলফ্রেড খোকন ও আমি-আমরা চার বন্ধু মিলিত হয়েছিলাম। এমনকি কবরের মধ্যে বসে কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবের ফাঁকে রাত ৩টার দিকে ফোন করলাম কবি নির্মলেন্দু গুণকে। গুণ দা তখনও পলাশীতেই থাকতেন। পাগলামি ভরা রাত আর আমাদের সেই উড়নচণ্ডী দিন পার করেছি, ভালো লেগেছে। সমাজ-সংসার রসাতলে গেছে। আর কবি আবুল হাসান আমাদের অন্তরে ঠাঁই পেয়েছেন পরম ভালোবাসায়। একজন কবির জন্যই তো এই ভালোবাসা থাকবে, সেটাই প্রজ্ঞাবিধান। কেননা, কবি বলেছেন, ‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভেতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও।’
|